কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

বঙ্গাব্দের সূচনা কীভাবে?

ইতিহাস পর্যালোচনা করে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে মতটি পাওয়া যায় তা হলো, বঙ্গাব্দের সূচনা হয় সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) শাসনামলে। বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। সে সময় এটি ছিল প্রধানত খাজনা আদায়ের উৎসব। এর আগে থেকে বাংলায় নতুন বছর উপলক্ষ্যে যেসকল উৎসব পালন করা হতো সে সবগুলোই আসলে চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে।

আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৬ সালে (৯৬৩ হিজরি) এবং এরপর তার শাসনামলে নতুন পঞ্জিকা চালু হয় ১৫৮৪ সালে। পরে চালু হলেও সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের স্মৃতিকে চিরভাস্বর করে রাখতে ফতেহউল্লাহ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ সনকে মূল ধরে তারিখ-ই-ইলাহী বিন্যাস করেন। তবে এর পূর্বে মুঘলরা বরাবরই হিজরি সন অনুসারে খাজনা আদায় করে আসতো। তাহলে আকবরের শাসনামলে বঙ্গাব্দ প্রচলন করার প্রয়োজন পরলো কেন?

মূলত রাজকার্যের ক্যালেন্ডারে এই পরিবর্তনটা এনেছিলেন আকবরের রাজদরবারের অন্যতম একজন নবরত্ন, ঐতিহাসিক আবুল ফজল। তিনি হিসাব করে বুঝিয়ে দেন যে, ৩২টি সৌরবর্ষ ৩৩টি চান্দ্রবর্ষের সমান হওয়ায় হিজরি সন অনুসরণ করলে চাষিরা অতিরিক্ত এক বছরের খাজনা দিতে বাধ্য হবেন। খাজনা আদায় যাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয় এবং চাষিদের যাতে কোনোভাবেই অতিরিক্ত খাজনা না দিতে হয়, সে কথা মাথায় রেখে সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ শিরাজি চান্দ্রমাস ও সৌরমাসভিত্তিক এক নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন। এর পেছনে শুধু খাজনা আদায়ে সুবিধা নয়, আকবরের ধর্মীয় চেতনা ও রাজনৈতিক অভিলাষও কাজ করেছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সর্বভারতীয় জাতি গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। সেজন্য তিনি একটি অভিনব সমন্বয়বাদী ধর্ম প্রচার করেন। নাম দেন দীন-ই-ইলাহী। প্রচলন করেন ইলাহী মুদ্রাও। মুদ্রা ও শিলালিপিতে আরবির পরিবর্তে ফারসি ভাষা চালু করেন। একই উদ্দেশ্যে নতুন সনও প্রবর্তন করেন, যার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহী।

ফতেহউল্লাহ শিরাজি এই সৌরবর্ষ কেন্দ্রিক পঞ্জিকাটি চালু করার সময় যে সৌরমডেলের সাহায্য নেন তা হলো, শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জি। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ অঞ্চলেই শকাব্দ অনুসরণ করা হতো। শকাব্দ অনুসরণ করেই বাংলার কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতেন। তাই এর ভিত্তিতে রাজস্ব আদায় করা সহজ। তাই ফসল তোলার সময়ের সাথে সমন্বয় রাখতেই তারিখ-ই-ইলাহী শকাব্দকে অনুসরণ করে বানানো হয়। ১৫৮৫ সাল থেকে এ নতুন সাল ‘ফসলি সন’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সাল বা ‘বঙ্গাব্দ’ নাম ধারণ করে।

তখন কিন্তু এই বঙ্গাব্দ বৈশাখে শুরু হতোনা, বরং শুরু হতো চৈত্র থেকে। আকবরনামাতে প্রথম থেকে সপ্তবিংশতম বর্ষ পর্যন্ত বর্ষ আরম্ভের যে-তারিখগুলি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় প্রতি বর্ষ ১১ মার্চ (১৪ বার) বা ১০ মার্চ (১০ বার) বা ১২ মার্চ (৩ বার) আরম্ভ হয়েছিল। চৈত্রের শুরুতে বর্ষ গণনা আরম্ভ হতো, কারণ শকাব্দতেও বৎসর শুরু হতো চৈত্রের মহাবিষুববার থেকে। এছাড়া পারস্যের নববর্ষ, যা নওরোজ নামে পরিচিত, পালিত হতো মার্চে – যখন আমাদের এখানে চৈত্র। তাই নওরোজের সাথে মিল রেখেই বঙ্গাব্দের সূচনা চৈত্র করা হতো বলেও অনেকে মনে করেন।

যেই শকাব্দকে অনুসরণ করে বঙ্গাব্দের সূচনা, সেই শকাব্দের প্রারম্ভ বছর নিয়েও বিতর্ক আছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আলবেরুনী উল্লেখ করেছেন যে বিক্রমাব্দ ও শকাব্দের মধ্যে পার্থক্য ১৩৫ বছর এবং শকাব্দের যাত্রা পরে। সুতরাং বিক্রমাব্দের শুরু ৫৭ খ্রিস্টপূর্ব হলে শকাব্দের শুরু ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই আলবেরুনীর তথ্যকেই সঠিক মনে করেন। মূলত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্তের’ সৌরবর্ষ গণনার বিধি মেনেই শকাব্দের মাস ও দিন গণনা করা হতো। ভারতবর্ষে যে কয়টি অঞ্চলে শকাব্দের প্রচলন বেশি ছিল তার মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাব, দাক্ষিণাত্য, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লি ও তামিলনাড়ু। এ তালিকায় বাংলা অঞ্চলের নামও ছিল। এমনকি তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরও এখানে শকাব্দের প্রচলনের প্রমাণ মেলে। পরে তিনি শকাব্দের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হিজরি সনের ব্যবহার শুরু করেন। এ হিজরি সন অনুযায়ী চাষিরা জমির খাজনা দিতেন ফসল ওঠার অব্যবহিত পর। হিজরি সন চান্দ্রমাস অনুযায়ী হওয়ার ফলে ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থার সংগতি আনা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সম্রাট আকবরের শাসনকালের ২৯ বছর পর এ সমস্যা সমাধানের পন্থা নিয়ে কথা ওঠে। এজন্যেই মূলত আকবরের আমলে শকাব্দের সাথে মিল রেখে বঙ্গাব্দ অনুসরণ করা শুরু হয়।

তাহলে, আকবরের সৌর হিজরি বৎসরের আরম্ভ ২১ মার্চ হয়ে থাকলে, বর্তমানে বঙ্গাব্দের আরম্ভ ১ বৈশাখ হয়ে গেলো কীভাবে? ৯৬৩ হিজরিতে হিজরি পঞ্জিকার প্রথম মাস ‘মহররম’ বৈশাখ মাসে শুরু হয়। তাই তার সঙ্গে মিল রেখে চৈত্রের বদলে বৈশাখকেই ধরা হয় ‘তারিখ-এ-ইলাহির’ প্রথম মাস। নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখ মাসের ১ তারিখে কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, যাকে রাজপুণ্যাহ্ বা রাজকর আদায়ের উৎসবও বলা যায়। তখন প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে ফেলে আসা বছরের বকেয়া খাজনা মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন এবং জমিদারের কাছারি থেকে নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। ভূস্বামী ও জমিদাররা এই দিনটিতে প্রজাদের নিয়ে পুণ্যাহ করতেন। সেই আমলে রাজপুণ্যাহ আর নববর্ষ ছিল সমার্থক। তাই জমিদাররা পরের দিন অর্থাৎ ১ বৈশাখ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর সঙ্গে সঙ্গে গান-বাজনা, যাত্রা, মেলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকৃতপক্ষে তাদের অর্থশোক ভোলানোর চেষ্টা করতেন। এরপর ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি যখন ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন তখন রাজস্ব আদায় আর ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। ধারণা করা হয়, এভাবেই মূলত শহরকেন্দ্রীক নববর্ষ পালনের সূচনা হয় ঢাকায়।

তবে আকবরের বহু আগেও কিন্তু বঙ্গাব্দের সূচনা হতে পারে, যদিও তা নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়না। যেমন, অনেক গবেষকের মতে বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। কারণ, যদি আকবরের রাজ্যাভিষেকের সাথে মিল রেখেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তন হয়ে থাকে, তাহলে তো বঙ্গাব্দের শুরু হওয়ার কথা ১৫৫৬ থেকে। কিন্তু তা না হয়ে বঙ্গাব্দের সূচনা করা হয়েছিল ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে। তাহলে কি ব্যাপারটা এমন যে ৫৯৩ সালেই আসলে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়, পরবর্তীতে আকবরের বাংলা বিজয়ের পর সেই বাংলা সনের সাথে তারিখ-ই-ইলাহীর মিল রেখে বঙ্গাব্দ চালু করা হয়? এছাড়া, বাঁকুড়ার ডিহাগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামে সম্রাট আকবরের আমলের বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরে প্রতিষ্ঠার তারিখ হিসেবে ১০২ বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে।

এই মতের বিপক্ষেও আসলে অনেক যুক্তি রয়েছে। শশাঙ্কের শাসনামলের সময়কালের যতো লেখাই আবিষ্কৃত হয়েছে কোনোটাতেই তারিখে বঙ্গাব্দের ব্যবহার নেই। বরং রয়েছে গুপ্তাব্দের ব্যবহার, যা কিনা গুপ্ত সম্রাটদের আমলে প্রচলিত ছিল। তাই পুরো ব্যাপারটাকেই শুধুমাত্র অনুমাননির্ভর বলা চলে।

আবার অনেকের মতে, বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন স্বাধীন গৌড় রাজা জয়নাগ। জয়নাগের মৃত্যুর পরে রাজা হয়েছিলেন শশাঙ্ক, যিনি ছিলেন জয়নাগের নিয়োগ করা মহাসামন্ত। ধরে নেওয়া যাক, জয়নাগের সেই বর্ষপঞ্জিকে শশাঙ্ক অব্যাহত রাখেন। তাহলে পরে যখন তিনি বঙ্গ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, তখন নিশ্চয়ই এই বর্ষপঞ্জি বঙ্গেও চালু হয়েছিল। গৌড় রাজ্য স্বাধীনতা হারানোর পরেও বঙ্গে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং একসময় তারই নাম হয়, ‘বঙ্গাব্দ’। টোডরমহল এই প্রচলিত বর্ষপঞ্জির সাথেই তারিখ-ই-ইলাহীর সমণ্বয় করায় এর ভিত্তি বছর থেকে গেল জয়নাগের সিংহাসনে আরোহণ করার বছরটাই।

তবে যে মতই সত্য হোক না কেন, আকবরের আমলেই বঙ্গাব্দ তার বর্তমান রূপ নিয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ বাঙ্গালির হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যেমন, তেমনই বাংলা নববর্ষ উদযাপনে দ্রাবিড়-আর্য-মুঘল-পাঠান উপাদান যে মিলেমিশে যাবে সেটিও খুব স্বাভাবিক। ইতিহাসের নকশি কাঁথায় সময়ের নানা ফোড়ে নতুন নতুন সাংস্কৃতিক উপাদানের রঙ্গিন সুতো যোগ হয়। রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত তাকে না মানতে চাইলেও, লোকসংস্কৃতির বহমান ধারা বহুত্বের বৈচিত্র্যকে যুগে যুগে সংরক্ষণ করে, বাঁচিয়ে রাখে।

তথ্যসূত্র :

  1. খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার, “প্রাচীন যুগের বাংলাঃ গঙ্গারাজ্য থেকে গৌড়”, বাতিঘর (২০২৩)
  2. আবুল কালাম মঞ্জুর মোরশেদ, “বাংলার লোক-সংস্কৃতি”, সূচীপত্র ( ২০১১)
  3. দৃষ্টিপাত, “বাংলা নববর্ষ প্রচলনের ইতিকথা”, প্রতিদিনের সংবাদ (২০২২)
  4. হুমায়ুন কবির, “শকাব্দ থেকে বঙ্গাব্দের জন্মকথা”, বণিকবার্তা (২০২৪)