‘আজিকার শিশু’ নামে সুফিয়া কামালের একটি ছড়া ছিল পাঠ্যবইয়ে। ছড়ার প্রথম চারটি লাইন এ রকম- ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/ তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।/ আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’
কবি সুফিয়া কামালরা যে বয়সে ঘুড়ি ওড়াতেন, বর্তমান যুগে সেই বয়সের শিশু-কিশোররা মত্ত মোবাইল গেইম,টিকটক নিয়ে। হবেই না বা কেন? আমাদের সময় আমরা স্কুলের খোলা মাঠে, বাড়ির সামনে বড় উঠানে, খেলার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কিংবা পরবর্তী প্রজন্মরা সে সুযোগটা পাচ্ছে না, সামনে হয়তো আর পাবেও না। কারণ আমাদের জীবনটাই হয়ে গেছে যান্ত্রিক। আমরা অভিভাবকরা চাই, আমাদের সন্তানরা ক্লাসে প্রথম হোক, জিপিএ-৫ অর্জন করুক। কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনা, কিসে তাদের আনন্দ, কি করলে তাদের সৃজনশীলতা, আগ্রহ, উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে? আমাদের শিশুদের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (আবেগজনিত বুদ্ধিমত্তা) জানার দায়িত্ব আমাদের। এই জানা তাদের শারীরিক ও আবেগীয়ভাবে বড় হতে সহায়তা করে।
একটি বিষয় জেনে আপনি অবাক হবেন তাহলো, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার এক গবেষণার ফলে দেখা যাচ্ছে, এখনকার ৯০ শতাংশ শিশুই স্মার্টফোন ও ট্যাব ব্যবহারে পটু। আর ৩–৪ বছর হতে না–হতেই একেক জন রীতিমতো স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। কারণ, প্রতি ১০ জন মা–বাবার মধ্যে ৭ জনই সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। আমরা অভিভাবকরা নিজেরা শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে বলি তারা মোবাইল গেইমে আসক্ত। কিন্তু তাদের জন্য কি কখনো ভেবে দেখেছি মোবাইল গেইমের বিকল্প কি হতে পারে?
আমদের দেশে প্রতিনিয়ত আউটডোর গেইমের সুযোগ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মোবাইল গেইম ও টিকটিক ভিডিও তৈরির আগ্রহ । যা খুব কম বয়সেই তাদের ব্রেইন, নার্ভ ও দৃষ্টিশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক ক্ষতি করছে।
তাই আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য মোবাইল গেইমের বিকল্প হতে পারে সুডোকু, রুবিকস কিউব, ট্যানগ্রাম, ব্লক গেইম, দাবাসহ বিভিন্ন রকম ম্যাথ পাজল গেইমসহ আরো অনেক শিক্ষণীয় খেলা। এছাড়াও দেয়া যায় মজার মজার গল্পের বই, আনন্দের সাথে গণিত চর্চা, কিশোর ম্যাগাজিন, বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন ইত্যাদি। এই সব হাতে কলমে শিক্ষণীয় খেলা ও বই শৈশব থেকে শিশুদের মাঝে সৃজনশীলতা, আগ্রহ,কল্পনাশক্তি,উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে শুরু করে কলেজ পর্যায়ে এধরনের খেলাধূলা গুলোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। তাহলে আমাদের শিশু-কিশোররা মোবাইল গেইম, টিকটক ভিডিও এগুলো নিয়ে সময় নষ্ট করবে না। এগুলো সম্পর্কে জানার ও খেলার সুযোগটি তৈরি করে দিতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদেরকেই। শিশুদের খেলনা কেনা বা উপহার দেয়ার সময় আমাদের যে বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন তাহলো খেলনাটি শিক্ষণীয় কিনা আর এটি শিশুর উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা? অনেক বিশেষজ্ঞ শিশুদের বন্দুক জাতীয় খেলনা কিনে দিতে নিষেধ করেন। কারণ এ ধরনের খেলনা শিশুদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলে। আবার খেলনাতে যেন কোন শিশু লিঙ্গ বৈষম্যের স্বীকার না হয় সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। আগামী দিনে একটি সুস্থ ও সুন্দর প্রজন্ম পেতে চাইলে আমাদেরকেই সেই সুন্দর পথ তৈরি করে দিতে হবে ।