রিভিউটি শুরু করছি বইটির একটি ছোট গল্প দিয়ে নাম ‘দুনিয়ার সুখী মানুষ ‘।
এক সওদাগর দিনে দিনে বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলেন। কোনো কাজে তাঁর মন বসে না, খিদে টিদে নেই, বুকে সর্বক্ষণ কেমন চাপ অনুভব করেন। পয়সাকড়ি, ধনদৌলতের অভাব নেই। তাঁকে সেবা করার জন্য চাকর-বাকর, দাসদাসী রয়েছে ঢের। তবু মন তাঁর ফাঁকা লাগে। একরাশ শূন্যতা ক্রমশ ধীরে ধীরে তাঁকে গিলে নিচ্ছে যেন। বিষাদে ডুবে যেতে যেতে এক সময় তাঁর মনে হল, মহৎ কোনো মানুষের উপদেশ পেলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতে পারেন।
একদিন সেই দুঃখী সওদাগর নাম করা এক ফকিরের কাছে এসে নিজের অবসাদের কথা খুলে বললেন, “ আপনি আমাকে এই মানসিক অস্থিরতা থেকে বাঁচান। সুস্থ- স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাই আমি।” তারপর সাধক ফকির সওদাগরকে বললেন, ‘বুঝলে সওদাগর, এই দুনিয়ায় যত আজব কান্ডকারখানা চলে, এই ধর, যা কারো কারো কাছে অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন, তা আবার অপর কারো কাছে স্পষ্ট, উদ্ভাসিত। যাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ, তাকে অন্য কেউ দেখতেই পাচ্ছে না। এই মজার খেলার কথা তুমি এখন বুঝতে পারবে না, তবে নিশ্চিন্ত থাক, তোমার অসুখ আমি সারিয়ে দেব। শুধু একটা কথা মাথায় ভালো করে গেঁথে নাও, তোমার রোগ সারানোর চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু খুব একটা সহজ সরল নয়। দীর্ঘ দিন লেগে যাবে। তুমি একটা কাজ কর, ভ্রমণে বেরিয়ে পড়। দেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে খোঁজ চালাও, দুনিয়ার সেরা সুখী মানুষটির। যতদিন না তাঁর দেখা মিলছে, তোমার তালাশ জারি রাখবে। যেদিন সেই সুখীতম মানুষটিকে খুঁজে পাবে, সেদিন সেই মানুষটির গায়ের জামা খুলে পরে নিয়ো। দেখবে, হাতে-নাতে ফল পাবে তুমি।′
সুখী মানুষের সন্ধানে সওদাগর ফকিরের কথা মতো বেরিয়ে পড়লেন। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান আর সবাইকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি দুনিয়ার সব থেকে সেরা সুখী মানুষ?′ তাঁর প্রশ্নের জবাবে অনেকই বলেন, না, আমি সুখী নই, আমি চরম দুঃখী মানুষ। আবার কেউ কেউ বলেন, হ্যাঁ, আমি সুখী, তবে আমার থেকেও সুখী ওই মানুষটি সওদাগর দৌড়িয়ে যান, আগের মানুষটির দেখানো ব্যক্তির কাছে, অধীর আগ্রহে জানতে চান, তিনি সব চাইতে সুখী মানুষ কিনা। এই ব্যক্তিও তাকে বলেন, সে সুখী বটে তবে তার থেকেও সুখী লোক থাকেন, ওই যে, ওইখানে। এমনভাবে, দুনিয়া ঘুরে ঘুরে, হাজারো-লাখ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন সওদাগর, তাঁর একই প্রশ্ন, অন্যদের একই উত্তর।
আরো পড়ুন:
হঠাৎ এমন সময় সওদাগর এক জায়গায় এসে সবার মুখে শুনলেন পেলেন, সামনে একটা বন আছে, সেই বনে একটা উঁচু গাছের ওপরে দুনিয়ার সেরা সুখী মানুষটি বাস করেন। সন্দেহ নিয়ে আবার সবাইকে জিজ্ঞেস করলে, কিন্তু সবার মুখে একই কথা, গাছে বসা লোকটাই দুনিয়ার সেরা সুখী মানুষ। তিনি সবসময় মহানন্দে সময় কাটান।
এবার সওদাগর ছুটতে ছুটতে সেই গিয়ে হাজির হয়ে শুনতে পেলেন হাসির আওয়াজ। সওদাগর মুখ তুলে দেখতে পেলেন অনেক উঁচু ডালে বসে আছেন একজন মানুষ। গাছের ডালপালায়, পাতায় ঢেকে আছে তাঁর মুখ, অর্ধেক শরীরটা খালি দেখা যাচ্ছে। সওদাগরের আর তর সইল না। লোকটার নামার অপেক্ষায় না থেকে তর তর করে তিনি গাছে উঠতে উঠতে চিৎকার করে বললেন, ‘আপনি কি দুনিয়ার চরমতম সুখী মানুষ? ′
– অবশ্যই, আমি এই জগতের সেরা সুখী ব্যক্তি।
– শুনুন, আল্লার দোহাই, আমি যথেষ্ট ধনী হয়েও বড়ো দুঃখী। এক মহান ফকির আমায় বলেছেন, সব থেকে সুখী মানুষের পরনের জামাখানি খুলে পরতে। আপনি, আপনার জামা খুলে আমায় দিন, তার বিনিময়ে যা চাইবেন তাই দেব।
গেছো লোকটি সওদাগরের কথায় হো-হো করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির শব্দে বনের সব গাছ দুলতে শুরু করল, পাতায় পাতায় হিল্লোল বয়ে গেল। তাঁর হাসি আর যেন থামতেই চায় না। এদিকে সওদাগর চটে গিয়ে বলেই ফেললেন, “আমার কথার গুরুত্বই দিচ্ছেন না আপনি। ”
লোকটি হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ঠিক কথাই বলেছ ভায়া। হয়তো আমি পাগল। তবে আরও একটু কষ্ট করে উঠে এস, দেখবে আমার কাছে জামা নেই। একেবারে উদোম হয়ে রয়েছি। ‘
এবার সত্যি মুষড়ে পড়লেন সওদাগর। এতদিন বাদে যাও বা সুখী লোকটিকে পাওয়া গেল, সে একেবারেই নাঙা! আশাহত গলায় তিনি বলে উঠলেন, ‘তাহলে! এখন আমি কী করব?‘
– এবার তুমি সুস্থ হয়ে যাবে সওদাগর। এত বছর ধরে যে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে গেছ তুমি, অজানাকে পাবার জন্য যে লাগাতার অন্বেষণ চালিয়েছ, এই অনুশীলনই তোমার সুস্থ হওয়ার চাবি-কাঠি। শোন সওদাগর, মানুষের আর যখন কোনো পথ থাকে না, তখন সে নিজের সব শক্তি কেন্দ্রীভূত করে, স্রোতস্বিনী নদীর ঝাঁপ দিয়ে পারাপার করে। প্রত্যেকের ভেতরই এমন গোপন শক্তি থাকে যা সে নিজেও বুঝতে পারে না। চর্চায় বেরিয়ে আসে।
গাছের ডালপালা সরিয়ে, দুনিয়ার সেরা সুখী মানুষটি যখন নীচে নেমে এলেন, তাঁকে দেখে সওদাগর তো তাজ্জব হয়ে গেলেন।
আসলে ওই গেছো লোকটাই তো সেই সাধক, সেই ফকির, যিনি তাঁকে সুখীতম মানুষের তালাশ করতে বলেছিলেন। সওদাগর, ফকিরকে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেসা করলেন, সাধু, এত বছর পর আপনি এসব কথা আমায় বলছেন! প্রথমদিনই তো বলতে পারতেন।’
– সাধু বললেন, তখন আমার কথা শোনার বা বোঝার মতন ক্ষমতা বা বোধ কিছুই তোমার ছিল না। আজ, তোমার অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক মানুষ দেখেছ, তুমি তার চেয়েও বড়ো কথা, শূন্যকে পাওয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছ, সব কিছু ছেড়েছুড়ে, এই গোটা অভিযানটাই তোমায় ভালো করে তুলবে।
এ ধরনের মোট ত্রিশটির মতো গল্প রয়েছে বইটিতে। যাঁরা সুফিবাদ পছন্দ করেন তাদের জন্য বইটি অসাধারণ। প্রতিটি গল্পই আপনাকে নিয়ে যাবে এক সুরভিত সুফি সৌরভে। এখানে বেশির ভাগ গল্পই মওলানা জালালুদ্দিন রুমি (র.)-এর ‘মসনবি’ থেকে নেওয়া, কয়েকটি অন্যান্য সুফি সাধকদের বলা গল্প।
ইসলামের অনুগামী ফকির-দরবেশরা পশমের পোশাক পরতেন বলেই তাঁদের সুফি বলা হত। উনারা সকলেই দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন, পথেই উনাদের জীবন ও শিক্ষা। মসজিদ ও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় কাঠামোয় আটকে না থেকেও ‘কোরান’-ই উনাদের আলো দেখিয়েছে। ‘কোরান’ এর বাণীর ভিতরেই তাঁরা জগৎ ও জীবনরহস্যের উত্তর খুঁজেছিলেন। তাঁরা খোদাকে খুঁজেছেন নিজের ও মানুষের হৃদয়ে, আর সেইসব বাণী সারা দুনিয়ায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্পে- কাহিনী আর কবিতায়। যেমন সুফি, কবি ও সাধক ফরিদউদ্দিন অত্তরের ‘পাখিদের জলসা’ বা জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনবি’।
‘সুফিসৌরভ’ নামটি যে নির্বাচিত হল, তার একটি কারণ, পশমের ( সুফিদের পোশাক) এক বিশেষ গন্ধ আছে, যা এই সংকলনের তিরিশটি গল্পে ছড়িয়ে পড়েছে। গন্ধটি দারিদ্র্যের হলেও আসলে আত্মার সৌরভই।
লেখক সীমা বল পেশায় সরকারি কর্মী। একসময় ঢুকে পড়লেন সুফি কাহিনীর জগতে। তারপর বাছাই করা কিছু গল্প দিয়ে সাজিয়ে ফেললেন সুফিসৌরভ বইটি।
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের অর্থ-বিত্তের কোন অভাব নেই তারপরও শান্তি খুঁজে পাননা। তাই মানবজীবনে প্রকৃত সুখশান্তি পেতে চাইলে অবশ্যই ভালো মানুষের সংস্পর্শ অর্থাৎ আল্লাহর ওলি-আউলিয়াদের সাহচর্য অর্জন করতে হবে। ভালো সাহচর্য একজন মানুষকে অতি সাধারণ অবস্থা থেকে অসাধারণ অবস্থায় নিয়ে যায়। তখন যাঁর অঢেল আছে সে যেমন শান্তি পায় ঠিক তেমনি যাঁর দরুন কিছুই নেই তিনিও মনে শান্তি পান। সেজন্য মানুষের জীবনে সৎ ও পবিত্র সংস্পর্শ খুবই প্রয়োজন।
এই বার্তাটিই যেন খুঁজে পাবেন ‘সুফিসৌরভ’ বইটিতে।
বইয়ের নামঃ সুফি সৌরভ
লেখকঃ সীমা বল
প্রকাশনীঃ অভিযান পাবলিশার্স
পৃষ্ঠাঃ ২১৫
মূল্যঃ ২২০