কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

বই পর্যালোচনা: প্রকৃতি, ভারতবর্ষ ও মাইজভান্ডারী দর্শন

সকল প্রকার জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষক প্রয়োজন। সেই জ্ঞান যে শুধুমাত্র পড়ালেখার জ্ঞান তা কিন্তু নয় । আপনি ভালো গাড়ি চালানো শিখবেন ওস্তাদ লাগবে। ভালো কম্পিউটার শিখবেন তাও ওস্তাদ ছাড়া শিখতে পারবেন না। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোভাবে চিনতে ওস্তাদ লাগবে না! এটি কি হয়? আল্লাহর অলি আউলিয়াগণ হলেন আল্লাহ ও রাসূলকে চেনানোর প্রকৃত ওস্তাদ। সেই আউলিয়াগণের সাথে প্রকৃতির রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক।

সেই সম্পর্কের প্রকৃতরূপ কিরূপ তা বিবৃত হয়েছে ড. আবদুল আজিম শাহ কর্তৃক রচিত ‘ প্রকৃত, ভারতবর্ষ ও মাইজভাণ্ডারী দর্শন ‘ গ্রন্থটিতে। যেখানে প্রকৃতি সেখানে আধ্যাত্মিকতা, যেখানে আধ্যাত্মিকতা সেখানে আল্লাহ।

আবার যেখানে সুর-তাল-লয় সেখানে সংগীত, যেখানে সংগীত সেখানে আধ্যাত্মিকতা। প্রকৃতি,সুর ও আধ্যাত্মিকতা একে অন্যের পরিপূরক যেন। প্রকৃতির সাথে অলি আউলিয়াদের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তা লেখক খুব সহজ,সুন্দর ভাষায় তুলে ধরেছেন। লেখকের ভাষায়, “ প্রাকৃতিক জ্ঞান মানেই আধ্যাত্মিক তথা রহস্য জ্ঞান। প্রকৃতির চর্চা মানেই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চর্চা। আধ্যাত্মিকতা যেমন মানবকে পরম প্রশান্তি দেয়, স্রষ্টার দিকে ধাবিত করে। তদ্রুপ প্রাকৃতিকতাও স্রষ্টার বিশালত্ব বুঝা ও অনুধাবন করতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন:

অলি আউলিয়াদের সাথে প্রকৃতির আছে এক অপূর্ব মেলবন্ধন। দুটোই যেন এক সুতোয় আবদ্ধ। এই কথাটি সত্য যে উনারা চাইলে ঘরে সাধনা করে আল্লাহকে পেতে পারতেন তাহলে পাহাড়, জঙ্গল, কিংবা গুহায় কেন গেলেন আল্লাহকে পাওয়ার জন্য? একথাটি চমৎকারভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ‘ প্রকৃতি, ভারতবর্ষ ও মাইজভাণ্ডারী দর্শন ‘ গ্রন্থটিতে।

গ্রন্থটিতে আলোচিত হয়েছে প্রকৃতির সাথে ভারতবর্ষের জ্ঞানের কী সম্পর্ক, মাইজভান্ডারী দর্শন ও এই দর্শনের আউলিয়াদের বিশালত্বের মাধ্যমে সাধন পদ্ধতি, জীবন দর্শনের সাথে প্রকৃতির কী সম্পর্ক, প্রকৃতির মধ্যে কেনই বা ডুবে থাকতেন তাঁরা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে খুব সহজ,সরল ভাষায় লেখক তুলে ধরেছেন।
জ্ঞানসাধকরা মনে করেন, সুখ-শান্তি এমন এক রত্ন, যা না থাকলে মানুষের জীবন পরিণত হয় নরকে।প্রশান্তিহীনতা মানুষের জীবনকে তিলে তিলে অস্থির করে তোলে। বিশেষ করে আজকের পৃথিবীতে মানুষ মারামারি, হানাহানি, মাদকাসক্তি, ধর্ষণ, পরকীয়া, আত্মহত্যাসহ বিচিত্র অশান্তি ও সংকটে নিমজ্জিত। তারপরও মানুষ চাই একান্ত শান্তি। সেই শান্তি পেতে পারেন আল্লাহ প্রেমিক আউলিয়াদের সংস্পর্শে।
অলি-আউলিয়াগণ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত এবং তাঁর মতো উদার। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) অলিদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা করেছেন, যেগুলো ‘ প্রকৃতি, ভারতবর্ষ ও মাইজভাণ্ডারী ‘ গ্রন্থটিতেও প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হলো ।

যেমনঃ
• সকলকেই ভালোবাসবেন, যেমন সূর্য সকলকেই আলো দান করে।
• সকল তৃষ্ণার্থকেই পানি দেবেন, যেমন দেয় নদী।
• সকলকেই আশ্রয় দেবেন, যেমন দেয় পৃথিবী।

লেখক বলতে চেয়েছেন যে, পঞ্চতত্ত্বের সাথে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আউলিয়াদের সাধন পদ্ধতির মিল রয়েছে। এখানে পঞ্চতত্ত্ব বলতে আকাশ, বায়ু,অগ্নি, পানি ও মাটি।
আউলিয়াগণ হলেন পৃথিবীর স্তম্ভ। উনারা পৃথিবীর প্রতিটি স্তরে স্তরে অবস্থান করে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতিনিধি হয়ে আধ্যাত্মিকতার আলোয় বিশ্বকে পরিচালনা করেন।

আমরা সকলেই শুনে ও পড়ে এসেছি যে,শকুন্তলা ও দুষমন্তর পুত্র ‘ ভরত’ এর নামানুসারে ভারতের নামকরণ হয়েছে কিন্তু লেখক গ্রন্থটিতে ভারতবর্ষে নামকরণ সম্পর্কে বলেন, ভা অর্থ জ্ঞান, আলো, কিরণ। রত অর্থ নিমগ্ন,চর্চা করা, লেগে থাকা। অর্থাৎ জ্ঞান চর্চায় নিমগ্ন থাকার নামই ভারত। পবিত্র বেদ গ্রন্থে ঋষিরা বলে গেছেন যে, জ্ঞানে নিমগ্ন থাকার নামই ভারত। লেখক ভারত এর নামকরণের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এভাবে, পবিত্র বেদ গ্রন্থ যখন রচিত হয় তখন শকুন্তলা দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের জন্মও হয়নি।

আল্লাহর অলি-আউলিয়াগণ কিংবা মাইজভান্ডার শরীফকে নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক কথা বলে থাকেন। আশাকরি বইটি পড়লে সেই দিক থেকে তাদের চিন্তার জগতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে।

লেখক মাইজভান্ডারী দর্শনকে উল্লেখ করেন ‘Spiritual Global University‘ হিসেবে। মহান আল্লাহ অসীম, তাঁর সৃষ্টি জগৎ তথা প্রকৃতিও বিশাল। ঠিক তেমনি প্রকৃতির মতো মাইজভান্ডারী দর্শনও বিশাল এবং এই দর্শনের আউলিয়াগণও বিশাল। আর এই মাইজভান্ডারী তরিকাটি যিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি হলেন বাংলাদেশের সুফিসাধক, সুফিগুরু গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহ (কঃ)। লেখক উল্লেখ করেন, বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে সব তরিকার মূল নির্যাসকে নিয়ে প্রাকৃতিকতায় ভরপুর বাংলাদেশের বার-আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত আধ্যাত্মিক নগরী নামে খ্যাত বিশ্ব সুফিবাদ ও দর্শনের মূল কেন্দ্র মাইজভান্ডার গ্রামে হযরত শাহসুফি মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহ (কঃ) সম্পর্ণ নতুন অত্যাধুনিক, সহজ, সরল কর্ম ও সাধনের দর্শন পদ্ধতি নিয়ে আগমন করেন।

এই দর্শন জ্ঞানের জগতে মহা সমুদ্রের চেয়েও গভীর, যার কারণে অনেকেই এনিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন।
প্রকৃতপক্ষে মাইজভান্ডার শরীফ হলো আউলিয়া তৈরির কারখানা।

তরিকাটি উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মচেতনাকে বিশেষভাবে তুলে ধরে। এটি এমন একটি শিক্ষা-দীক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ডিগ্রি বা সনদের কোন গুরুত্ব নেই, নেই বয়সের সীমাবদ্ধতা। এখানে অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজন নেই বই খাতা।যোগ্যতা হিসেবে প্রয়োজন ভক্তি-আদব-বিনয়, আমিত্বের বিসর্জন ও আত্মার সমপর্ণ।

অনেকেই আবার সেমা, কাউয়ালী,তাজিমী সিজদা নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করেন, এ বিষয়টি লেখক যুক্তিসহ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের এই ভারতবর্ষে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে

যে অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে এবং অলি-আউলিয়া, মুনি ঋষিদেরদের কর্ম যে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত সে বিষয়গুলোও অত্যন্ত সহজ, সরল ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে লেখক বইটিতে তুলে ধরেছেন।

লেখক ড. আবদুল আজিম শাহ চট্টগ্রাম জেলার আধ্যাত্মিক নগরী নামে খ্যাত ফটিকছড়ির মতি ভান্ডার শরিফের আধ্যাত্মিক সাধক গাউছে ভান্ডার হযরত মতিয়র রহমান শাহর (কঃ) পৌত্র। লেখক নিজেও একজন আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলের ব্যক্তিত্ব হওয়ায় পঞ্চতত্ব,সৃষ্টিতত্ব এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আধ্যাত্মিক ও মাইজভাণ্ডারী দর্শন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ভারতের জামশেদপুর সেন্টার অব অ্যাস্ট্রলজিক্যাল স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ফর পাবলিক ওয়েল ফেয়ার থেকে ‘ অ্যাস্ট্রলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক লেখকের আরো তিনটি বই হলোঃ অ্যাস্ট্রলজি,অ্যাস্ট্রনমি ও আধ্যাত্মিকতা, ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সৃষ্টিতত্ব ও পঞ্চতত্ব এবং আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞান।
মাইজভান্ডারী দর্শন হলো সু-বুদ্ধির দর্শন( ইতিবাচক মনোভাব)। বর্তমান বিশ্বে যদি এই সু-বুদ্ধির দর্শন পৌঁছানো যায় তাহলে বিশ্ব সম্প্রদায় ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করবে।
আশাকরি প্রতিভাবান এই লেখকের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকৃতি, ভারতবর্ষ,মাইজভান্ডারী দর্শন ‘ পাঠককে আধ্যাত্মিকতা ও মাইজভাণ্ডার শরিফ সম্পর্কে জানতে, বুঝতে আগ্রহী করে তুলবে।

বইয়ের নামঃ প্রকৃতি, ভারতবর্ষ ও মাইজভান্ডারী
দর্শন।
লেখক: ড. আবদুল আজিম শাহ।
প্রকাশনী: মওলা
পরিবেশক: মূর্ধন্য
বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৪৪
মূল্য: ২৫০ টাকা মাত্র।