বইয়ের নাম : ভাবনার খেরোখাতা
লেখক : শেখ বিবি কাউছার
পরিবেশক : মূর্ধন্য।
প্রকাশনায় : মওলা প্রকাশনী।
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৪ (অমর একুশে বইমেলা)
পৃষ্ঠা : ১১১
মূদ্রিত মূল্য : ৳৩০০
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
সূফি ভাবধারার লেখক, জনাব শেখ বিবি কাউছার ম্যাম (প্রভাষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম)’র #ভাবনার_খেরোখাতা বইটি মূলত লেখকের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়াদির উপর লিখিত বিভিন্ন নিবন্ধের সংকলন। লেখকের ভাষায়, “ভাবনাসমূহের খণ্ডিত চিত্র।”
এই বইটিতে শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সূফিবাদ ও মনিষীদের জীবনী নিয়ে লিখিত।
তিনটি অংশে বইটি লেখা হয়েছে।
প্রথমভাগটি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে লেখা। এই ভাগে প্রায় ২২টি নিবন্ধ রয়েছে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর। তন্মধ্যে…
- বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের করণীয়।
- কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, প্রোগ্রামিং ও আমাদের মতুন প্রজন্ম।
- তরুণদের জন বিনিয়োগের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।
- মাতৃভাষা বিজ্ঞান চর্চা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
- শিশুদের মোবাইল গেইমের বিকল্প হতে পারে যা।
- ইসমাইল আল-জাজারি: রোবট শিল্পের জনক মধ্যযুগের মুসলিম প্রযুক্তিবিদ।
- দেশের পোষাক শিল্প ও শিল্পখাতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এই অংশটি মূলত তরুণ প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণার।
দ্বিতীয়ভাগটি লেখা হয়েছে #ধর্মওসূফিবাদ নিয়ে। এই অংশে ১১টি নিবন্ধ রয়েছে। তন্মধ্যে…
- কসিদায়ে বুরদাহ প্রিয় নবিজি (দরূদ) এঁর প্রেমের অনন্য নিদর্শন।
- হিংসা-বিদ্বেষবিহীন পৃথিবী গড়তে চাই, মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি (রহ.)’এরঁ প্রেমদর্শন।
- মাইজভাণ্ডার অধ্যাত্ম শারাফাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.)।
- আত্মার শুদ্ধতা ও আমাদের করণীয়।
- সূফিবাদের সোহবত বা সাহচর্য কেন প্রয়োজন? ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় ভাগে মিশরের বিশ্ববিখ্যাত কবি, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও আশিকে রাসূল (দরূদ), ইমাম শরফুদ্দীন বুসিরী (রাহ:)’র ‘কাসিদায়ে বুরদাহ’র অংশটি হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। ইমাম বুসিরী (রহ.) একসময় রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর শরীর অবশ হয়ে যায়। একপর্যায়ে নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। তখন তিনি প্রিয় নবিজি (দরূদ) এঁর প্রশংসায় একটি কাসিদা রচনা করে তার ওসিলায় আল্লাহর দরবারে রোগমুক্তি কামনা করেন। স্বপ্নযোগে তিনি রাসূলে পাক (দরূদ) এঁর দর্শন লাভে ধন্য হন। নবিজিকে তিনি কাসিদাটি পড়ে শুনান, নবিজি খুশি হয়ে তাঁর বরকতময় হাত মোবারক ইমাম বুসিরীর শরীরে বুলিয়ে দেন এবং স্বীয় চাদর (বুরদাহ) মোবারক তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেন। তৎক্ষনাৎ তিনি সুস্থ হয়ে যান। ঘুম থেকে জেগে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণ সুস্থ দেখতে পান। [ সুবহানাল্লাহ]।
তখন থেকেই এই কাসিদাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফারসি, উর্দু, তুর্কি, জার্মানি, ইংরেজি, বাংলাসহ বহু ভাষায় এই কাসিদাটি অনুদিত হয়। অতি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় এটি বহু দেশের পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভুক্তি পায়। সারাবিশ্বের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এই কাসিদাটি পরিচিত ও সমাদৃত।
“মাওলা ইয়া সাল্লি ওয়া সাল্লিম দা ইমান আবাদান
আলা হাবি-বিকা খাইরিল খলকি কুললিহি মি।”
তৃতীয়ভাগটি লেখা হয়েছে মনীষীদের জীবনী নিয়ে। যেখানে ৬টি নিবন্ধ রয়েছে। তন্মধ্যে…
- নারী জাগরণের আলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া।
- বিশ্বের গর্ব বাংলার বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম।
- মহকবি হামিদ আলী (চট্টগ্রাম রাউজানের ক্ষণজন্মা কবি) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এই অংশের “বিশ্বের গর্ব বাংলার বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম” কলামটি সকলের পড়া উচিত।
ড. জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামের কৃতীসন্তান। তিনি নিউটম, আইস্টাইন, স্টিফেন হকিংদের সমপর্যায়ের বিজ্ঞানী। কথিত আছে, আধুনিক বিশ্বে সাত জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম নিলেও সেখানেও ড. জামাল নজরুল ইসলামের নাম চলে আসবে। তিনি বহির্বিশ্বে জেএন ইললাম নামে পরিচিত এবং বাইরের বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ। ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। সারাবিশ্বে বিজ্ঞানীমহলে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও কর্মজীবনের বড় সময় বাংলাদেশে কাটানো এই বিজ্ঞানীর কথা আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না। জ্ঞানীদের চর্চা ও মূল্যায়ন না করাটা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে ডালভাতের মতোই স্বাভাবিক বিষয়।
কিছু মজার মজার তথ্য দিই, ড. জামাল নজরুল ইসলামের ক্ষুরধার মেধায় মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশ দম্পতি তাদের সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘জামাল।’ বাবা ছিলেন খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলমা আর তাঁর মাতা রাহাত আরা বেগম। যিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকটি উর্দুতে অনুবাদ করে খুবই সুনাম অর্জন করেছিলেন রাহাত আরা বেগম। তাঁদের বাসায় খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের আনাগোনা থাকতো। তাঁদের কলকাতার বাসায় বিদ্রোহী কবি, কাজী নজরুল ইসলামও গিয়েছিলেন। কবির নামের সাথে মিল রেখেই তাঁর বাবা-মা তাঁর নাম রেখেছিলেম ‘জামাল নজরুল ইসলাম। ‘
বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাটা অনেক বড় জগত। কিন্তু তিনি যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তা নিয়ে গবেষণা খুবই কম হয়। আর তা হলো, “সামগ্রিক মহাবিশ্বের ভবিষ্যত বা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী?”- তা নিয়ে একমাত্র ড. জামাল নজরুল ইসলামই বিশ্বমানের গবেষণা করেছেন।
এই বইয়ের উপরিউক্ত কলামে তাঁর গবেষণা, রচনা, ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে।
সংক্ষেপে বইটিকে ধর্ম ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মেলবন্ধন বলা যায়।
লেখক শেখ বিবি কাউছার (ম্যাম) সম্ভ্রান্ত সূফি পরিবারে জন্মগ্রহণ, সূফি ভাবধারা ও পরিবেশে বেড়ে উঠায় সূফিবাদের প্রতি প্রবল অনুরাগী। পেশায় শিক্ষক হলেও সাহিত্যের প্রতি রয়েছে প্রবল ঝোঁক। পড়াশোনা করেছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে। বর্তমানের চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজে ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
গতানুগতিক পড়াশোনার সিস্টেমের বাইরে গিয়ে লেখকের সুন্দর চিন্তাভাবনা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও তরুণ প্রজন্মের সুন্দর আগামী নিশ্চিতকরণে কাজ করা সত্যিকার অর্থে প্রশংসার দাবী রাখে।
আমি লেখকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
পরিশেষে আহ্বান করছি, চমৎকার বইটি সবাই সংগ্রহে রাখুন, পড়ুন ও অন্যকে উপহার দিন।
রিভিউ লিখেছেন: আনিসুল মোস্তফা