একদিন, দুদিন, তিনদিন করে একজন শাহনাজের সাহসী গল্প পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ ছেড়ে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে এ নারীর সাহসী যাত্রা। অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ার ‘উবার’ এর বাইকার শাহনাজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল একটা স্কুটি। অন্য নারীকে বিয়ে করে শাহনাজের স্বামী চলে গেলে অন্ধকার নেমে আসে শাহনাজের জীবনে। পিতা হারা দু কন্যাকে নিয়ে শাহনাজের যুদ্ধের যাত্রা শুরু হয় সে থেকে। তাঁর এ সাহসী গল্প উঠে আসে নিজের বাইকের এক যাত্রীর ফেসবুক পোস্টে।
রাফিউজ্জামান সিফাত নামের এ ব্যাক্তির দেয়া পোস্টের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় শাহনাজের জীবন যুদ্ধের গল্প। রাফিউজ্জামান সিফাত যা লিখেছেন-
‘‘উবারে কল দিলাম, ওপাশে রাইডার ফোন ধরে প্রথমেই বললেন, ‘ভাইয়া আমি মহিলা ড্রাইভার, আমার বাইকে চড়তে আপনার আপত্তি নাই তো?’ জবাবে বললাম, আপত্তি থাকবে কেন! তিনি বললেন, আমি আসছি ভাইয়া।ভেসপা চালিয়ে রাইডার এলেন। রাইড শুরুর পর জানালেন, কেবল মেয়ে হওয়ার কারণে অনেক প্যাসেঞ্জার তার বাইকে চড়ে না। আক্ষেপ করে জানালেন, ‘মাঝে মাঝে আমি অনেক দূর থেকে পিকআপ পয়েন্টে আসি। প্যাসেঞ্জার যখন দেখে আমি মেয়ে মানুষ। তখন তারা বলে, মেয়েদের বাইকে উঠব না, ক্যানসেল করে দেয়। আমি প্রতিবাদ করি না। আমার লস হলেও ক্যানসেল করে দেই। জোর করা তো যায় না। তাই না?’ এই রাইডার আরও বললেন, ‘ভাইয়া প্রতিদিন এমন অনেক অভিজ্ঞতা হয়, আগে মন খারাপ হতো, ভাবতাম, ছেড়ে দেব। কিন্তু আমাকে তো রোজগার করতে হবে, আমার দুইটা মেয়ে আছে। ওদের বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছেন। মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে আমাকেই মানুষ করতে হবে!মেয়েরা চাইলে পাঁচ মিনিটে হাজার টাকা কামাই করতে পারে। আমি তা চাই না। আমি সম্মানের সাথে রোজগার করি। আপনার মতো মানুষরা যখন আমাদের প্রশংসা করেন, তখন খুব ভালো লাগে।’ মনে সাহস পান বলেও জানান।
জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ওরা কেমন ব্যবহার করে? তিনি বললেন, ‘ওরা খুব ভালো। আমাকে পারলে স্যালুট দেয়। আমি রুলস ব্রেক করি না। বড় মেয়ে ক্লাশ নাইনে পড়ে। ছোটটা ক্লাস ওয়ানে।’’ এই রাইডার আমাকে বললেন, ‘দোয়া করবেন, বড় মেয়েটা ইন্টার পাস করে ভালো কোথাও চাকরি পেলে আমি নিশ্চিন্ত।’ শাহনাজ আপার বাইকে চড়ে আমি ফিল করলাম। একটা মেয়েকে প্রতিদিন কতশত প্রশ্নবোধক চোখের সামনে জীবন চালাতে হয়। মোহাম্মদপুর থেকে টিএসসি, যত সিগন্যালে বাইক থামলো, আশেপাশের মানুষজন অবাক চোখে আমাদের বাইকের দিকে চেয়ে রইলো। কয়েকজনের চোখে কৌতুক, কয়েকজনের নাক সিটকানো ভাব। পুরুষতান্ত্রিক ইগো! মেয়ে ড্রাইভারের পেছনে ছেলে বসেছে!
সিফাত আর ফেসবুক টাইম লাইনে আরও লিখেছেন, ‘মেয়েদের স্কুল কলেজে যেতে দেবেন না, বলে যারা আমাদের মেয়েদের দমিয়ে রাখতে চায়, তারা সমাজের জন্য কোনোদিন মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনেনি। খুশির কথা, শাহনাজরা ওইসব রক্তচক্ষুকে গোনাতেও ধরেন না। সমাজ পরিবর্তন ঘটে শাহনাজ আপার মতো তেজি মানুষের হাত ধরেই।’
আরো পড়ুন
- সাগু বা সাবুদানা আসলে কি?
- সমুদ্রে লঘুচাপ ও নিম্নচাপ: সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা
- শুভ জন্মদিন চিত্রা পাড়ের কৌশিক!
এরপর #-হ্যাশট্যাগ দিয়ে সিফাত লিখেছেন, ‘স্যালুট শাহনাজ আপা।’
শাহনাজের এ গল্প এখানে শেষ হতে পারতো! কিন্তু সমাজের কিছু কীট শাহনাজদের দমিয়ে রাখতে চায়। স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে ভাইরাল হওয়া আলোচিত এ নারীর জীবনে হঠাৎ নেমে আসে আরেক ঝড়।
মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) বিকেল ৩টার দিকে শাহনাজের মাহিন্দ্রা ব্র্যান্ডের নীল রঙের স্কুটিটি অভিনব কৌশলে ছিনতাই হয় রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানার খামারবাড়ি এলাকা থেকে। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন শাহনাজ। শেরে বাংলা নগর থানায় জিডি করেন তিনি। থানায় দায়ের করা জিডিতে বলা হয়, গত ১০ জানুয়ারি শ্যামলী এলাকায় আসামি জনির (২৭) সঙ্গে পরিচয় হয় শাহনাজের। জনি নিজে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাওয়ে বাইক চালায় বলে পরিচয় দেন শাহনাজের কাছে। তিনি শাহনাজকে আশ্বাস দেন, তার জন্য একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন।
সেই আশ্বাস অনুযায়ী মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শাহনাজকে খামারবাড়ি আসতে বলেন জনি। পরে সেখান থেকে যেতে বলেন বিমানবন্দর এলাকায়। এভাবে কয়েকটি স্থান ঘুরিয়ে শাহনাজকে ফের খামারবাড়ি এলাকায় আসতে বলেন জনি। বিকেল ৩টার দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে চায়ের টং দোকানের সামনে স্কুটি রেখে চা খেতে বসেন শাহনাজ ও জনি। এসময় শাহনাজের কাছে স্কুটি চালানোর নিয়ম জানতে চান জনি। পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর কথা বলে চম্পট দেন বাইক নিয়ে।
মুহুর্তেই ঘটনার খবর ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে। শের-এ-বাংলা নগর থানা পুলিশ ও তেজগাঁও জোনের পুলিশ অফিসারেরা দ্রুত স্কুটিটি উদ্ধারে তৎপর হয়। একমাত্র আয়ের অবলম্বন হারিয়ে অসহায় শাহানাজ সিদ্ধান্ত নেয় স্কুটিটি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তার হেলমেট মাথা থেকে খুলবেন না। কয়েকটি সংগঠনও এগিয়ে আসে শাহানাজের চোখের জল থামাতে। কেউ নতুন স্কুটি কিনে দিতেও হাত বাড়ায় তার দিকে। তবে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পুলিশ নারায়নগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার রঘুনাথপুর এলাকা থেকে প্রতারক জুবাইদুল ইসলামকে আটক সহ উদ্ধার করেন স্কুটিটি। তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিল্পব সরকার স্কুটিটি সাহানাজকে ফেরত দিয়েছেন এবং সাথে তার সন্তানদের জন্য উপহার হিসেবে দিয়েছেন নগদ দশ হাজার টাকা। দ্রুত সময়ের মধ্যে অসহায় শাহনাজের স্কুটি উদ্ধারে বাংলাদেশ পুলিশ যে তৎপরতা দেখিয়েছে তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য।
এবং সাথে আম জনতা আশা করে বাংলাদেশ পুলিশ মানুষের দুর্দশার সময় একই ভূমিকা পালন করবে। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশ। সালাম শাহনাজ আপা!