একটা ট্রফির জন্য কতো জেনারেশন কিংবা ৩ দশকের বেশি সময়ের অপেক্ষা। বাতিগোল খ্যাত বাতিস্তুতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, দেখেছিলাম এরিয়েল ওর্তেগা, পাবলো আইমার, হার্নান ক্রেসপো, কার্লোস তেভেজ, রেক্যোয়েলমে, ডি মারিয়া কিংবা ম্যানসিটির হয়ে দুর্ধর্ষ খেলা সার্জিও আগুয়রোকে নিয়ে। প্রতি দশকে আমরা কোন না কোন নতুন ম্যারাডোনার আগমনী শুনতাম আর আশায় বুক বাঁধতাম এবার বুঝি হবে। স্বপ্ন দেখেছিলাম আরো একটা বিশ্বকাপ হবে। যখন আমরা এমন স্বপ্ন দেখছিলাম তখন রোমারিও, রোনালদো, কাফু, বেবেতো, রবার্তো কার্লোস, রিভালদো, কাকা, রোনালদিনয়োদের চলছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ।
প্রতিবারের মতো আবারও আমরা শুনলাম আরেক চোট্ট জাদুকরের কথা। নতুন ম্যারাডোনা আসছে। এ আবার নতুন কী? শুনে শুনে দুই-তিন দশক পার করে এসেছি। তারপরও তাকে নিয়ে খুঁজছিলাম, কে সে? দেখলাম রোজারিওর ছোট্ট শিশুটির ফুটবল নিয়ে অসাধারণ কারিকুরি। পায়ের সাথে যেনো ফুটবল আঁটা দিয়ে লাগিয়েছে। ড্রিবলিঙের নতুন কারিশমা দেখলাম।
শিশুর জাদুকরী ড্রিবলিং ধরা পড়ে স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনার রাডারে। হরমোনের সমস্যার ভোগা ছেলেটিকে চিকিৎসা দিলো। একাডেমিতে শুশ্রূষা দিয়ে বড় করলো। চমকের উপর চমক দিয়ে জায়গা করে নিলো মূলদলে।
সযোগ এসেছিল স্পেনের হয়ে খেলার। কিন্তু জন্মভূমির মানুষকে ভুলেনি ছেলেটি। ২০০৬ বিশ্বকাপে তরুন ছেলেটি জায়গা করে নিয়েছে মূল দলে। মাসচেরানো, আয়মার, রিক্যোল্মে, তেভেজ, মিলিতোদের সাথে সে তরুন খেলবে। বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনির সাথে একই দলে তরুন লিওনেল মেসির হলো অভিষেক। ছোট্ট ঝলক দেখলাম তার।
২০১০ বিশ্বকাপ। পৃথিবীর শক্তিশালী ফরোয়ার্ড লাইন আর্জেন্টিনার। ডিয়েগো মিলিতো, গঞ্জালো হিগুইন, কার্লোস তেভেজ, সার্জিও আগুয়রো, লিওনেল মেসি। ক্লাবের হয়ে সে সময় আলো ছড়াচ্ছিল তারা। তাছাড়া ডাগ আউটের কে ছিল জানেন? ফুটবলে সর্বকালের সেরাদের একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মাঠে আর ডাগ আউটে সবইতো ছিল, কিন্তু সেবারও হলোনা!
২০১৪ বিশ্বকাপ। এবার ফাইনালে আর্জেন্টিনা। এবার হবে কিছু। ক্লাবের হয়ে জেতা ফরোয়ার্ডদের সারি সারি ট্রফি আর ক্রেস্টের চেয়ে দেশের হয়ে শোকেসে একটা ট্রফি দেখা অনেক শান্তির আর গৌরবের। ফাইনাল চলছে। ক্লাবের হয়ে হালি হালি গোল করা হিগুইন গোলরক্ষককে একা পেয়েও বল তুলে দেয় বারের উপরে। বিশ্বকাপটাই বুঝি বারের উপরে পাঠিয়ে জার্মানিকে দিয়ে দিলো। জাদুকর মেসি? খুব কাছে গিয়েও আবারো অধরাই থেকে গেলো বিশ্বকাপ! গোল্ডেন বল জেতা মেসির কাছে তখন দেশের হয়ে অন্তত একটা ট্রফিরই আরাধনা ছিলো।
২০১৫ কোপা আমেরিকা ফাইনাল। চিলির বিরুদ্ধে টাইব্রেকারের ১ম শট এই মেসিই মেরে দিল বারের উপর দিয়ে। আবার স্বপ্নভঙ্গ। মেসি কাঁদল, কাঁদালো তার শতকোটি ভক্তদের। রাগে-ক্ষোভে ২০১৬-তে মেসি আচমকা ঘোষণা দিল, “For me, the national team is over”
পেলে ম্যারাডোনার কাতারে যাওয়া হলোনা মেসির। এতো এতো ট্রফির ভিড়ে বিধাতা দেশের হয়ে একটা ট্রফি ছুঁতে দিলোনা লিওকে। আমরা মেনেই নিয়েছিলাম যে, এক জীবনে মানুষ সবকিছু পায়না।
২০১৮ বিশ্বকাপ। দেশের জন্য আবারো ফিরলেন সে সময় পর্যন্ত ফিফার ৫ বারের ব্যলন ডি’অর জয়ী মেসি। ফুটবল বিধাতা মনে হয় তাঁর কানে কানে বলেছিলো, খেলে যাও লিও। ফুটবল বিধাতা থেকে তোমার এখনো পাওনা আছে। সেবারও কোয়ার্টারে যাত্রা শেষ হয়েছিলো চ্যাম্পিয়ন ফরাসীদের কাছে হেরে।
২০২১ কোপা আমেরিকা। ১৯৯৩ সালের পর মেসির হাত ধরেই ব্রাজিলের মাঠিতে চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে ট্রফি জিতলো। মেসিরা এবার কাঁদলো তবে এবার আনন্দের। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমা জিতে আরো এক ট্রফি উঁচিয়ে ধরলো।
২০২২ বিশ্বকাপ। গ্রুপের সহজ প্রতিপক্ষ সৌদির কাছে হেরে লালিত স্বপ্নে চপেটাঘাত পড়লো। কাতার থেকে সৌদিরা ট্রল শুরু করলো, ‘Where is Messi? Where is Messi?’ তাল মেলালো প্রতিপক্ষ শিবির। এরপর একে একে মেক্সিকো, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়াদের হারিয়ে ফাইনালে। ২০১৪ হবেনা তো আবার? মেসিরা জবাব দিলো, লালিত সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরলো। বিধাতা প্রয়াত কিংবদন্তী ম্যারাডোনা যোগ্য উত্তরসূরি মেসিকে দুহাত ভরে দিলো।
ডি মারিয়াকে এবার বিদায় জানাতে হবে মাথা উঁচু করে। ২০২৪ কোপার ফাইনাল। ম্যাচের আগে দর্শক-পুলিশ সংঘর্ষ বাইরে। মেসি, ডি মারিয়ারা মাঠে। এবার ডি মারিয়ার জন্যে জিততে চায় তারা। একটা রাজসিক বিদায় হবে তার। ম্যাচের তখন ৬৪ মিনিট। যাকে ঘিরে এই আর্জেন্টিনা মরণপণ লড়ে সে মেসি কিনা কুড়াতে কুড়াতে মাঠের বাইরে! ডাগ আউটে বসে শিশুর মতো কাঁদছে এ মেসি! এমনটা দেখিনি আগে। ট্রফি হারানোর পর কাঁদতে দেখেছিলাম। এটা কিসের কান্না? যার শোকেসে গোল্ডেন বুটের সারি, সে কেনো আসল বুট মাঠিতে আছড়ে ফেললো? এসব কিছু হয়তো আমরা মেসির মুখেই শুনবো। ডি মারিয়াকে সহযোদ্ধারা ট্রফি অনেকটা নিশ্চিত করে দিয়েই বিদায় দিলো। মারিয়াও কাদলো। আরো একটা ট্রফি আলবিসেলেস্তেদের।