মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের নামিদামি প্রতিষ্ঠান লেকসাইড স্কুলের ছাত্র ছিলেন বিল গেটস। তাঁর জন্মও সিয়াটলে। লেকসাইড স্কুলে ছিল বিরাট বিরাট কম্পিউটার। কম্পিউটারগুলো ব্যবহার হতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর জটিল সব পরিসংখ্যান বের করতে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুযোগ ছিল কম্পিউটারগুলো দেখার। প্রতিদিন বিকেলে বিল কম্পিউটার রুমে যেত। স্কুল ছাত্ররাও তাদের শারীরিক শিক্ষা ফাঁকি দিয়ে চলে আসতো কম্পিউটার রুমে।
অল্প বয়সী বিলের মাথায় ভূত চাপে কম্পিউটারগুলো আদতে কিভাবে কাজ করে তা বের করার। বিলের এমন আগ্রহ দেখে তাঁর শিক্ষকও আগ্রহী হয়ে সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু বিলের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হতোনা।
অন্য ছাত্ররা কম্পিউটারের প্রোগ্রাম নাড়াচাড়া করলেও বুঝতে পারতোনা। আর সহপাঠীরা কেন বুঝতোনা তা আবার বিলের মাথায় ঢুকে না। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিল সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কম্পিউটার মানুষের জীবন মানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। তবে তা কোন যন্ত্রের মাধ্যমে না, সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ১৯৬৮ সালে বয়সে ২ বছর বড় পল অ্যালেনের সাথে বন্ধুত্ব হয় বিলের। দুই বন্ধু মিলে রাতদিন খেঁটে বানিয়ে ফেলে জীবনের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের কাজ ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্লাসের শিডিউল তৈরি করা। বাজারে তখন যেসব সফটওয়্যার পাওয়া যেত তাদের থেকে বিল আর পলের সফটওয়্যার ছিল অনেক সহজ আর ব্যবহার উপযোগী। যদিও সে প্রোগ্রাম বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমন উদ্ভাবনে খুশী হয়ে স্কুলের প্রিন্সিপল দুই বন্ধুকে পুরস্কৃত করেন।
১৫ বছর বয়সে বিল হাতে পেলেন ৫০০ ডলারের চেক। সেদিনই মূলত বিল বুঝতে পেরেছিলেন যে, কম্পিউটার প্রোগ্রামই একটা ভালো ব্যবসা হতে পারে। কিন্তু সে সময় তথ্যপ্রযুক্তিকে যেভাবে গোপনে গড়ে তোলা হচ্ছিল তাতে এ ব্যবসার কথা মাথায় আনাও পাগলামি ছিল বটে। কিন্তু বিল হাল ছেড়ে দিতে রাজি না। ১৭ বছরে স্কুল শেষ করে স্থির করেন কম্পিউটারের ব্যবসা শুরু করার। কিন্তু বিল যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সাথে পরিচিত তা সে সময়ের অবিভাবক কিংবা অধিকাংশ মানুষ বুঝতোনা। বিলের বাবা-মাও গুরুত্ব দেননি বিলের কথায়। তাঁদের কাছে বিলের সে পরিকল্পনা ছিল নিছক সময় নষ্ট করার মতো।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আইনজীবী বাবার এক প্রকার আদেশে ১৯ বছর বয়সে বিল পাড়ি জমান বোস্টনের বিখ্যাত হারবার্ডে। ভর্তি হন আইনে। হারবার্ডেও বিলের জন্য অপেক্ষা করছে আরো এক বিশ্বয়ের। ১৯৭৪ সালে একটা অদ্ভুত ধাতব বাক্স নিয়ে লেখা এক প্রবন্ধ চোখে পড়ে বিলের। যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পার্সনাল কম্পিউটার নিয়ে। সাধারণ লোকের কাছে এটা বড় ব্যাপার না হলেও বিলের কাছে ছিল তাঁর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ। বিলের চিন্তা করলেন এই কম্পিউটারের জন্য এমন এক সফটওয়্যার তৈরি করবে, যা সাধারণ মানুষও ব্যবহার করতে পারবে।
বিল আর তাঁর হাইস্কুলের বন্ধু পল মিলে সিদ্ধান্ত নেন সেই কম্পিউটারে জন্য কিছু প্রোগ্রাম বানাবেন। দুজন মিলে পুরো একমাস রাতদিন পরিশ্রম করে বানিয়ে ফেললেন একটা সফটওয়্যার। বিলের হারবার্ডের বন্ধু মন্টি ডেভিডফ তাঁদের কাজের সহযোগিতা করেছিলেন। যদিও হারবার্ডে এ কাজ করা খুব সহজ ছিলনা। বিল আর পল এ প্রোগ্রাম বানাতে হারবার্ডের কম্পিউটার ব্যবহার করেছিল, যা ব্যবহার করার অনুমতি ছিলনা তাঁদের জন্য। আবার বিলের স্কুল বন্ধু পল অ্যালেন হারবার্ডের ছাত্রও ছিলনা। এদিকে লুকিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করার বিষয় জেনে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে বিলকে তিরস্কার এবং আর এমন করবেনা বলে মুচলেকা নেয়া হয়। কিন্তু নাছোড়বান্দা বিল সে তিরস্কার পাত্তা না দিয়ে বন্ধু পলকে নিয়ে বানিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সফটওয়্যার।
নিজেদের বানানো সে সফটওয়্যার এক বিশেষ ফিতার মধ্যে রাখেন, যা ফ্লপি ডিস্কের পূর্বসূরি হিসেবে পরিচিত। সে সফটওয়্যার বিল প্রথম মাইক্রো কম্পিউটার সংস্থার কাছে ৩ হাজার ডলারে বিক্রি করেন। সেই অর্থকে মূলধন করে বিল আর পল মিলে একটা কোম্পানি চালু করেন। যা আজকের বহুল পরিচিত মাইক্রোসফট। Micro বা ছোট কম্পিউটার আর Soft বা সফটওয়্যার। সে সময় বিলের বয়স ছিল ২০ এর কম।
আইনজীবী বাবার চাপ সত্ত্বেও বিল বিখ্যাত হারবার্ড ছেড়ে ফিরে আসেন নিজ শহর সিয়াটলে। বন্ধু পলকে নিয়ে সেখানে ১০০ বর্গমিটারের একটা অফিস ভাড়া নেন বিল। ১৯৭৮ সালে মাইক্রোসফটের কোম্পানির কর্মচারি ছিল ১১ জন। কোম্পানির ক্লায়েন্ট নিয়ে আসার দায়িত্ব নিজেই নেন বিল।
ম্যারিয়াম লুভো নামের এক ভদ্র মহিলাকে নিয়োগ দেন বিল তাঁর সেক্রেটারি হিসেবে। ম্যারিয়াম লুভো মাইক্রোসফট অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এক চমৎকার ঘটনা উল্লখে করেন। তিনি জানান, ইন্টারভিউর দিন এলোমেলো চুল ওয়ালা একটা ছেলে অফিসে প্রবেশ করে ম্যারিয়ামকে ‘হ্যালো’ বলে প্রেসিডেন্টের রুমে প্রবেশ করে। আবার বের হয়ে দ্রুত কম্পিউটার রুমে ঢুকে যায়। ম্যারিয়াম তা দেখে দৌড়ে গিয়ে আরেক কর্মচারি স্টিভকে জানায়, এই মাত্র একটা ছোট ছেলে কম্পিউটার রুমে ঢুকেছে! কী করি বলুনতো? স্টিভ উত্তর দেন, বাচ্চা কাকে বলছেন? উনিই তো আপনার হবু বস, উনিই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট! ম্যারিয়াম রীতিমত অবাক, এই পিচ্ছি ছেলে আমার বস? ম্যারিয়াম আবার প্রশ্ন করেন, ওর বয়স কতো? স্টিভ জানায় ২০। ভাববেননা আগামী বছর ২১ হয়ে যাবে!
ম্যারিয়াম বাড়ি গিয়ে সব ঘটনা জানায় নিজের স্বামীকে। স্বামী ম্যারিয়ামকে পরামর্শ দেন যে, কাল গিয়ে অফিসের চেকবই ভালো করে চেক করে নেবে, ব্যাংককে টাকা আছে কিনা! কারণ বছর কুড়ির একটা ছেলে মাস শেষে তোমাকে কী মাইনে দেবে! যদিও আস্তে আস্তে ম্যারিয়াম বুঝতে পারলেন, এই তরুণ অনেক পরিশ্রমী এবং আত্মবিশ্বাসী। ম্যারিয়াম আরো জানান, বিল তাঁর লক্ষে অটল থাকতো। লক্ষ অর্জনে কোন হেলা করতোনা।
আরো পড়ুনঃ
একদিন ম্যারিয়াম সকালে অফিসে প্রবেশ করতেই দেখলেন, বিল অফিসের মেঝেতে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যারিয়াম স্টিভকে জানালেন, বিল অসুস্থ মনে হয়। ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে চাইলেন ম্যারিয়াম। স্টিভ জানালেন, ডাক্তারের দরকার নাই। সম্ভবত বিল সপ্তাহের শনি-রবিবার অফিসেই কাটিয়েছে। হয়তো কোন একটা কাজ শেষ করতে চেয়েছিল বিল। কাজ শেষ করে হয়তো মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে জেগে বাসায় গিয়ে ফিরে আবার কাজে যোগ দেবে সে।
ম্যারিয়াম জানালেন, সবকিছু যেন বিলের কাছে একেকটা চ্যালেঞ্জ। যা বিল অতিক্রম করতে চাইতো। যাই হোক না কেন, বিল এর শেষ দেখে ছাড়তেন। বিলের দ্রুত গাড়ি চালানো চিল অন্যতম শখ। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দায়ে একবার জেলেও যেতে হয়েছিল বিলকে।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বিল এক ঐতিহাসিক ব্যবসায়িক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে সাইবার দুনিয়ায় বিল একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিলের জীবন ঘুরিয়ে দেয়ার সে ঐতিহাসিক চুক্তির বিস্তারিত থাকবে পরের পর্বে। চোখ রাখুন দ্বিতীয় পর্বে!