‘উইঘুর’ শব্দটি ‘উয়্যুঘুর’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সংঘবদ্ধ। এ জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে।
চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ৫ শতাংশ মুসলিম। ২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। কাজাখস্তানে ২ লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরগিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় ৪ হাজার, ইউক্রেনে ১ হাজারের মতো উইঘুর লোক বাস করে।
প্রাচীন এ সম্প্রদায়ের লোকদের উইঘুর না বলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও। ১৯২১ সালে উজবেকিস্তানে এক সম্মেলনের পর উইঘুররা তাদের পুরোনো পরিচয় ফিরে পায়। ১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা উইঘুর জাতি এ বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নত করেনি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয় আর জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে। সাইফুদ্দিন আজিজি তখন সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির গভর্নর ছিলেন।
আরও পড়ুন:
জিনজিয়াং চীনের অন্যতম সর্ববৃহৎ একটি অঞ্চল। এর আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১২ গুণ। চীনের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এ এলাকা আয়তনে সে দেশের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীর। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখের মতো। এর মধ্যে মুসলমান প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ। প্রায় ৫৮ শতাংশ মুসলিম।
মধ্যযুগে তাং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে সেখানে ইসলাম ধর্ম ও আরবদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ফলে স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন সেখানে। উইঘুর বললেই আজকে মুসলিম জনগোষ্ঠী বোঝানো হয়। অন্যদিকে, চীনা মুসলমানদের হুই বলা হয়। উইঘুরের বর্ণমালাও আরবি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এরা তুর্কি ও আরবি প্রভাবিত। জিনজিয়াংয়ে বিপুল পরিমাণ খনিজ ও তেলসম্পদ মজুত রয়েছে।
১৮৮৪ সালে কিং রাজত্বের সময় জিনজিয়াং চীনের একটি প্রদেশ হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট সেনারা জিনজিয়াংয়ে অভিযান চালায়। এর সূত্র ধরে চীনের হান সামরিক গোষ্ঠী জিনজিয়াংয়ে অভিবাসী হয়েছে। ১৯৫৫ সালে জিনজিয়াং চীনের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। হান সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিরুদ্ধে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে বহু মানুষ নির্যাতিত হয়। বিপুল সংখ্যায় কাজাখ জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী কাজাখস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে উইঘুর মুসলমানদের সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের বিরোধ সৃষ্টি হয়। একসময় তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। গত শতাব্দীর শেষে উইঘুর মুসলমানরা স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে।
প্রথম আলো অবলম্বনে