কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

‘ওর মায়েরতো আর কেউ থাকলো না।’

“সাতাশে রমজান। আমরা সবাই ইফতার করতে বসেছি। ইফতারের ঠিক একমিনিট কি দুইমিনিট আগে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলের লোহার দরজা অনেক শব্দ করে খুলে গেলো।পাকিস্তান আর্মিরা ভেতরে ঢুকে পড়লো। আমাদের সবাইকে লাইন-আপ করতে বললো। আমরা লাইন-আপ করলাম। ওরা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে করে সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল।

ওর মধ্যে আমি, মানিক, মাহবুব আলাদা বসা ছিলাম। তো, আমি দ্বিধায় ভুগছিলাম, কাদেরকে মারবে? আমাদেরকে না ওদেরকে?

পরে আমি একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ব্রিগ্রেডিয়ার শাদুল্লাহকে জিজ্ঞাস করলাম, আপনি আমাদেরকে নিয়ে কী করছেন?

তখন উনি খুব হাসিমুখে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো, দেখো আজকের এই দিনটা (২৭ রমজান) অনেক পবিত্র দিন। এইদিনে যদি কেউ মরে যায়, সে সরাসরি আল্লাহপাকের কাছে চলে যায়।

আমি তারে বললাম, আপনি কি প্রহসন করছেন? এই কথার মানে কি? তিনি বললেন, কথার মানে খুব সহজ, আজ তোমাদের মেরে ফেলবো। আমি বললাম, আমরা তিনজন এখানে, তেতাল্লিশজন ওখানে, এই ডিভিশানটা কেন? তিনি বললেন, সাতদিন আগে ওরা ধরা পড়েছিলো, ওদের মৃত্যুটা আজ হবে। আর আগামী পরশুদিন তোমাদেরটা হবে।

ঐ সময় ভয় পেতাম না, তবে একটুখানি হলেও বিচলিত হতাম। আমাদের সামনেই ৪৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে সূরা পড়িয়েছে, আমাদের সামনে থেকে নিয়ে গেছে। আমি ওদের সাথে দোয়াদরুদ পড়েছি, কথা বলেছি। যেমন, নজরুল আমাকে বলেছিলো, বুলবুল তুই যদি কখনও পাকআর্মি দেখিস, ওদের মাথায় একটা করে গুলি করবি। বাতেন বলেছিলো, আমার কাছে শুধু একটা চাদর আছে, এই চাদরটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিবি।

কামাল আর সেরু মিঞা, ওরা কিন্তু ছেলে এবং বাবা। কামাল খুব শক্ত ছিলো, আমার বয়েসী। আর সেরু মিঞা ছিলো তৎকালীন মহতপুর থানার ওসি। সেরু মিঞা ঝরঝর করে কাঁদছিলো। কামাল সামনে এসে তার বাবা সেরু মিঞাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। এবং সে একটা কথাই বলেছিলো যে, বাবা, যুদ্ধ করতে এসে মরবো- এটাইতো স্বাভাবিক। আর তুই কাঁদিস? তুই কাঁদলেতো আমার কান্না পায়, তুই কাদিঁস না।

সেরু মিঞা আমার সামনে এসে বললো, আচ্ছা বুলবুল তুই দেখ, ওর মায়েরতো আর কেউ থাকলো না। আমি বাবা, ও ছেলে। ওর মা কী নিয়ে থাকবে!

তখন আমাকে কামাল বললো, অত চিন্তা করিস না। আমার মায়ের সাথে দেখা হলে….. আমার মাকে তুই দেখবি কিনা জানিনা…. তবে রাস্তায় কোন পাগলীর সাথে দেখা হলে ভাববি যে সেটাই আমার মা…”

১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একটা টিভি অনুষ্ঠানে শুনিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এমন এক অজানা ইতিহাস। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ লগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেশের চলচ্চিত্র শিল্পসহ সঙ্গীত শিল্পে সক্রিয় ছিলেন। গত ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ইং তারিখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একুশে পদক এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার প্রাপ্ত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।