তহবিল সংগ্রহের জন্য কনসার্ট ‘বেনেফিট কনসার্ট’ আয়োজন এই সময় বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয়। এরকম কনসার্ট সর্বপ্রথম আয়োজন হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। বিখ্যাত সে কনসার্ট “দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে জীবন বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে চলছিল খাবারের সংকট, কলেরার মতো রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে। চরম এক মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল সে শরণার্থী শিবিরগুলোতে।
রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনঃ
পণ্ডিত রবি শঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং ভারতীয় সঙ্গীতকে ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে প্রথম তুলে ধরেন। এর প্রভাবে ১৯৬৫ সালে বিখ্যাত বিটলস্ ব্যান্ড-এর জর্জ হ্যারিসন সেতারের সুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলে রবিশঙ্করের সাথে যোগাযোগ হয় এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দীক্ষা নেন। ভারতে এসেছেন কয়েকবার। তিনি ভারতীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এই বন্ধুত্ব রবি শংকরকে খুব অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিমন্ডলে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দুরাবস্থায় ব্যথিত করে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত পাওয়া সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করকে।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশঃ
যদিও এর আগে ১৯৭০ এ বাংলাদেশের ভোলায় আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য কিছু করার কথা ভাবছিলেন রবি শঙ্কর। তাঁর ভাবনা জানান ছাত্র ও বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে। এরপর বিটলসের নিজস্ব কোম্পানি অ্যাপেল রেকর্ডসে রবি শঙ্কর রেকর্ড করেন ‘জয় বাংলা’ আর হ্যারিসন তার ‘বাংলাদেশ’। উদ্দেশ্য গানের বিক্রি ও রয়ালটি বাবদ টাকা বন্যাদুর্গতদের জন্য ব্যয়। এই উদ্দেশ্যটা নেওয়া হয়েছিলো রেকর্ডিং শুরুর আগেই। ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। রবি শঙ্কর অনুরোধ এবার পরিবর্তন করে হ্যারিসনকে একটা কনসার্ট আয়োজন করা যায় কিনা ভাবতে বলেন। কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ শরণার্থীদের সাহায্য করবেন। রবিশঙ্কর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ও সাময়িকীর সংবাদগুলো পাঠান জর্জের কাছে। জর্জ এ ব্যাপারে তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আই, মি, মাইন’ এ লিখেছেন – ‘বিষয়টি কী, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার ব্যাপারে আমার বোধ হয় তাকে সাহায্য করা উচিত।‘ তিনি লিখেছেন, ‘এভাবেই জড়িয়ে গেলাম। পরে যা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠে”।
১৯৭০ সালে বিটলস ভেঙ্গে আলাদা হয়ে গেলে জর্জ সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। এরিমধ্যে তার ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ অ্যালবাম ব্যাপক সাফল্য পায় ও তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। জর্জ সম্মত হওয়ার পরে নিজেই যোগাযোগ করেন আরও শিল্পীদের সাথে। তবে পল ম্যাককার্টনি সোজা ‘না’ বলে দিলেও রিঙ্গো স্টার রাজী হন। কনসার্টে গাইতে সায় দেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেলের মতো তারকারা। এরিক ক্ল্যাপটন এই কনসার্টের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ মাস পর কোনো সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গাইলেন এবং বব ডিলানও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শ্রোতা দর্শকদের সামনে এলেন।
উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত সরোদ বাদক ওস্তাদ আলি আকবর খান, তবলা বাদক ওস্তাদ আল্লা রাখা খান আর তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। তারা বাংলা ধুন নামে একটি ধুন পরিবেশন করেন। জানা যায়, এর আগে কখনো কোনও কনসার্টে এক সঙ্গে এত তারকা সঙ্গীতশিল্পী অংশগ্রহণ করেননি। ফলে এই কনসার্টকে ঘিরে সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ। একমঞ্চে দামী সব তারকা উপস্থিত হবেন জেনেই হয়তো মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যেই দুটো কনসার্টের ৪০ হাজার টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
এরকম অনুষ্ঠানে সাধারণত সাংবাদিকরা ফ্রি টিকেট পেয়ে থাকেন, তবে সাংবাদিকরা এ উদ্যোগের নেপথ্য কারণ জানতে পারলে ১২ হাজার ডলার অনুদান দেন আয়োজকদের। কনসার্ট থেকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ দশমিক ৫০ ডলার তুলে ইউনেসকোকে দিয়েছিলেন আয়োজকেরা।
সে সময় মার্কিন সরকার সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে তাদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছিল। সে দেশেই এরকম একটা কনসার্ট আয়োজন বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। জর্জ তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘আই মি মাইন ‘ বইয়ে লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, “ও, হ্যাঁ, এখনো এটা চলছে।” আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম।”
রবিশঙ্কর কনসার্টে আসা অসংখ্য দর্শকের উদ্দেশ্যে বলেন- “আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা শিল্পী। আমরা শুধু এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সঙ্গীত বাংলাদেশের মানুষদের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে আপনাদের সাহায্য করুক।”
কনসার্টের বড় আকর্ষন ছিল জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান। কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি, রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান, লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ নিয়ে অবিস্মরণীয় সে গানের কথা ও সুর জর্জ নিজেই করেছেন।
জর্জ করুণ বিলাপের সুরে গভীর মানবিক আবেদন নিয়ে গাইলেন-
“মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইদ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ;
টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প, বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ।
অলদো আই কুডন্ট ফিল দ্য পেইন, আই নিউ আই হ্যাড টু ট্রাই;
নাউ আই অ্যাম আসকিং অল অব ইউ টু হেল্প আস সেইভ সাম লাইভস।”
কনসার্টের পর এক সাক্ষাতকারে হ্যারিসন বলেছিলেন: “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিলো একটি নৈতিক পদক্ষেপ … আমরা দেখিয়েছি যে রাজনীতিকদের চেয়ে শিল্পীরা ও সাধারণ মানুষ বেশি মানবিক। মানুষ রক শিল্পীদের চ্যারিটির জন্য পারফর্ম করাকে গ্রহণ করেছে।” নিজের জীবিনিগ্রন্থে জর্জ লিখেন- ‘এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যাঁরা বলেন, “ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।’’
এরিক ক্ল্যাপটন স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন- “কনসার্টটির কথা যখন ভাবি শিল্পী হিসেবে আমরা গর্বিত বোধ করি। সেদিন আমরা কেউ পাঁচ মিনিটের জন্যও নিজেদের কথা চিন্তা করিনি, আমরা সবাই ভাবছিলাম আরও অনেক বৃহৎ একটি ঘটনা আর আমাদের দায়িত্ব নিয়ে।”
নিউ ইউর্কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটির মাধ্যমেই বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার খবর আরো ব্যাপকভাবে পৌঁছে গিয়েছিল মার্কিন মূলক থেকে পৃথিবীব্যাপী।
তথ্য উপাত্তঃ বিডি নিউজ ২৪, বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া