১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানী আর্মি জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণে কেন জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না? এ প্রশ্ন একটা গোষ্ঠী থেকে বারবার আসে। আরো প্রশ্ন আসে পাকিস্তানী আর্মি কেন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ কেরেনি? কেন ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল?
এসব প্রশ্ন যেমন এদেশের কিছু মানুষের বারবার আসে, তেমনি এটা নিয়ে ভারতের কিছু মানুষ, কিছু মিডিয়া ৭১ এর আমাদের বীরত্বকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে চায়। ভারতের বলিউডও কম যায়না। রীতিমতো ৭১ এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে পাকিস্তানের সাথে তাদের যুদ্ধ বলে দেখিয়েছে। এসব বিতর্ক তাদের নিজেদের জন্যও অপমানের। আসুন এসব বিতর্কের অবসান করি। আমি করছিনা, ঐতিহাসিক সে আত্মসমর্পণ দলিলেই এর সমাধান আছে। জেনারেল ওসমানী কেন আত্মসমর্পণে ছিলেন না, তার সমাধানও ওসমানী নিজেই দিয়ে গেছেন।
আরো পড়ুনঃ
এসব প্রশ্ন ভবিষ্যতে আসতে পারে সে আশংকা থেকেই সম্ভবত আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিলে একটা বাক্য জুড়ে দেয়া হয়েছিল। বাক্যটা- “জেনারেল কমান্ডিং ইন চিফ ইন্ডিয়ান এন্ড বাংলাদেশ ফোর্স ইন দ্য ইস্টার্ন কমান্ড”। এই “বাংলাদেশ ফোর্স” শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে ‘ভারত বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছে’ এই বিব্রান্তির অবসান হয়ে যায়। সে সময়ে আমাদের দূরদর্শী নেতারা এসব বিতর্কের অবসান করে দিয়েছেন।
আত্মসমর্পণে জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতি এবং বক্তব্য
মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী আত্মসমর্পণে কেন উপস্থিত ছিলেন না, এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা চলে। তবে সে বিতর্কের উত্তর জেনারেল ওসমানী নিজেই দিয়ে গেছেন। জেনারেল ওসমানীর সে বক্তব্য পাওয়া যায় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদরদপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের লেখা ‘একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা’ গ্রন্থে। ওসমানীর সে সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন-
ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোন দেশ নয়।
ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশরের পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকা) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাউ ক্যান আই!
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল জেনারেল মানেকশরের পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে।”
পাশাপাশি কেন একলা মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এ প্রশ্নেরও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন জেনারেল ওসমানী।
পাশাপাশি কেন একলা মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এ প্রশ্নেরও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন জেনারেল ওসমানী।
“যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্য নাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সে নীতিমালা মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিল না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকত না কিছু। পাকিস্তানিরা জেনে শুনে সে ঝুঁকি নেয়নি। তাছাড়া 90000 যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিল না। তখনো নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!”
তথ্যসূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরাধ, সম্পাদনাঃ আরিফ রহমান।