কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

“তুমি আসবে জানি আঁধার রাতে, জ্বালবে চেরাগ লালা”

কবিতাটা সাঈদ সিদ্দীকির লেখা। তবে বেশীরভাগ মানুষ জানেন এটা কাজী নজরুল ইসলামের। কে লিখেছেন তা নিয়ে কথা না বলে বরং কী বলতে চেয়েছেন তা নিয়েই বলি। কবিতাটা কবে কখন কী পরিস্থিতিতে লিখেছিলেন জানা নাই। শুধু ভাবছি কবির স্বপ্নেও কী কামলিওয়ালা নবী এসেছিলেন? না হয় এভাবে কীভাবে লিখতে পারেন কামলিওয়ালার সম্মানে! ইতিহাসতো বলে নবী আসেন প্রেমিকের অন্ধকার ঘরে আলো জ্বেলে। কবির আঁধার ঘরে চেরাগ জ্বালিয়ে কামলীওয়ালা নবী এসেছেন কিনা জানা না গেলেও কবি শরফুদ্দিন বুসিরির ঘরে এসেছিলেন ‘মাওলা ইয়া সাল্লি ওয়াসাল্লাম দায়িমান আবাদান…’ শুনতে। সেখ সাদীর ঘরে এসেছেন ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি’র চতুর্থ চরণ মিলিয়ে দিতে। একটু জেনে নিতে চাই প্রেমিকের কাছে প্রেমাস্পদ কীভাবে আসেন।

‘কাদ জা’কুম মিনাল্লাহি নুর ওয়া কিতাবুল মুবিন’ অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে এক উজ্জল জ্যোতি (নূর) ও সুস্পষ্ট কিতাব (কুরআন) তোমাদের নিকট এসেছে।

কুরআনের সূরা মায়েদার এ আয়াতের ‘উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর)’ দ্বারা নবী মোহাম্মদ (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকে বিতর্ক করে। বিতর্কে না গিয়ে চলুন সিরাতের প্রাচীন গ্রন্থ ইবনে ইসহাকের ‘সীরাতে ইবনে ইসহাক’ ও ইবনে হিশামের ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’ এ বর্ণিত মা আমিনা স্বপ্নে কী দেখতেন। নবীজি গর্ভে থাকাকালে মা আমিনা স্বপ্নে দেখতেন, তাঁর ভেতর থেকে এমন এক আলোকরশ্মি বের হয় যা দিয়ে তিনি সিরীয় ভূখণ্ডের বুসরার প্রাসাদসমূহ দেখতে পেতেন। এ আলোকরশ্মিই মূলত কুরআনে বর্ণিত ‘মিনাল্লাহি নূর’ বা ‘উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর)’। যে নূর (জ্যোতি) কামলিওয়ালা নবীর নূর। ৬৩ বছর বয়সে তাঁর বসরিয়ত সুরত তিরোধান হলেও প্রকৃত রূপে তিনি প্রেমিকের ঘরে চলে যান প্রেমিক যখন প্রেমাস্পদকে গভীরভাবে ডাকেন।

(১)
কবি শেখ শরফুদ্দিন বুসিরীর জন্ম ৬০৮ হিজরীর দিকে মিসরে বুসির নামক স্থানে। তিনি একাধারে বহু ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, কবি ও একজন কামেল বুজর্গ ছিলেন। এক সময় কবি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ অচল হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যান। একের পর চিকিৎসায় আরোগ্য লাভে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে নবীজি (ﷺ) এর প্রশংসায় লম্বা এক কসিদা লিখে ফেলেন। লেখা শেষ হলে এক জুমার রাতে নির্জন ঘরে গভীর মনোযোগ ও ভক্তিভরে নিজের লিখিত কসিদা (কবিতা) আবৃত্তি করতে থাকেন। আবৃত্তি করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে যান কবি। গভীর ঘুমে কবি স্বপ্ন দেখেন, কবির ঘরে ‘মিনাল্লাহি নূর’ বা ‘উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর)’ নবী (ﷺ) শুভাগমন করেছেন। আনন্দে আত্মহারা কবি আবৃত্তি করতে লাগলেন নিজের লেখা কসিদা। আবৃত্তির শেষের দিকের চরণ “কাম আবরাআত আসিবান” অর্থাৎ- কতো চিররুগ্ন ব্যক্তিকে নিরাময় করেছে প্রিয়নবীর পবিত্র হাতের স্পর্শ- পাঠ করলে প্রেমাস্পদ নবীর হাত মোবারক দিয়ে প্রেমিকের সমগ্র দেহ মুছে দেন। খুশী হয়ে নবী নিজের নকশাদার ইয়ামনী চাঁদরখানা কবির দেহে জড়িয়ে দিলেন।
স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় কবির। আহা! কে এলেন কে এলেন! প্রেমাস্পদ নবী কোথায় লোকালেন! কবি নিজের শরীরে আবিষ্কার করলেন সে ইয়ামনী চাঁদর। নিজেকে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত আবিষ্কার করা পাগলপ্রায় কবি বাজারের দিকে ছুটছেন আর শোকরিয়া আদায় করছেন।
কবিতো ঠিকই লিখেছেন- তুমি আসবে জানি আঁধার রাতে, জ্বালবে চেরাগ লালা… নবী কামলিওয়ালা।

শেখ শরফুদ্দিন বুসিরির সে বিখ্যাত কসিদা কত শিল্পী কতভাবে গেয়েছেন। ইউটিউবজুড়ে রয়েছে একাধিক শিল্পীর গাওয়া সে কসিদার অংশবিশেষ।

মাওলা ইয়া সাল্লি ওয়াসাল্লিম দা’ইমান আবাদান
আলা হাবিবীকা খায়রিল খালকি কুল্লিহিমি।।

অর্থাৎ- সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠতম তোমার প্রিয় সখার পরে
সালাত সালাম পাঠাও গো রব যুগ থেকে যুগান্তরে।।

হুয়াল হাবিবুল্লাজি তরযা শাফায়াতহু
লিকুল্লি হাউলিম মিনাল আহওয়ালি মুকতাহিমি।

অর্থাৎ- তিনি ঐ হাবীব (ﷺ), তাঁর গোলামের উপর আগত সকল বিপদাপদে যার সুপারিশের আশা করা হয়।। সংক্ষেপিত।

১৬৫ শ্লোকবিশিষ্ট এ সুদীর্ঘ কবিতা কসিদা-এ-বুরদা নামে অধিক পরিচিত। বুরদা শব্দের অর্থ নকশাদার চাঁদর। কসিদার প্রকৃত নাম ‘আল কাওয়াকিবুদ দুররিয়াহ ফী মাদহি খায়রিল বারিয়াহ’।

(২)
বালাগাল উলা বি-কামালিহি,/কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি,/হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি,/সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।। দরূদ হিসেবে প্রচলিত এই ছন্দোবদ্ধ আরবী চতুস্পদী কোথায় না পড়া হয়। ফারসি কবি বিশ্ববিখ্যাত সাধক শেখ সাদীর লেখা এ কবিতা (দরূদ) এতো জনপ্রিয়তা পাবার রহস্য কোথায়?
শেখ সাদী এই চতুষ্পদীর প্রথম তিন লাইন লেখার পর চতুর্থ লাইন মেলাতে পারছিলেন না। অনেক দিন চলে যায় কিন্তু একটি সন্তোষজনক লাইন পেতে ব্যর্থ হন। একদিন ঘুমের ঘরে প্রেমিক শেখ সাদীর ঘরে স্বপ্নে আসেন প্রেমাস্পদ কামলীওয়ালা নবী (ﷺ)। জিজ্ঞেস করলেন সাদীকে, হে শেখ সাদী! আপনি এতো অস্থির কেন, কি হয়েছে আপনার? শেখ সাদী চতুর্থ লাইন না লিখতে পারার ব্যর্থতার কথা আকুলভাবে জানান নবীজিকে। প্রেমাস্পদ নবী প্রেমিক শেখ সাদীকে চতুর্থ লাইন লিখতে নির্দেশ দিলেন, আপনি লিখুন- ‘সাল্লু আলায়হি ওয়া আলিহি’। অর্থাৎ- ‘পেশ করুন তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি দরুদ ও সালাম ।’ কবির কবিতায় আবারো- তুমি আসবে জানি আঁধার রাতে, জ্বালবে চেরাগ লালা… নবী কামলিওয়ালা।
চলুন পাঠ করি আবার-
বালাগাল উলা বি-কামালিহি
কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি
হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি
সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।।
অর্থাৎ- “পূর্ণতায় তিনিসুউচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন
বিদুরিত হয়েছে সকল অন্ধকার তাঁর সৌন্দর্যের ছটায়
সম্মিলন ঘটেছে তাঁর মাঝে সকল উন্নত চরিত্রের
পেশ করুন তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি দরুদ ও সালাম ।”

শিরোনামের কবিতা দিয়েই লেখাটা শেষ করছি-

দুঃখের দিনের দরদী মোর
নবী কামলীওয়ালা
তুমি আসবে জানি আঁধার রাতে
জ্বালবে চেরাগ লালা।।

জাগবে যবে বক্ষে আমার
অপার তৃষ্ণা সাত সাহারার
জানি ধরবে তুলে কন্ঠে আমার
কাওসারের পিয়ালা।।

মাঝ দরিয়ায় উঠলে তুফান
তাই না আমি ডরি
জানি আমায় কূলে নেবে তোমার
শাফায়াতের তরি
তোমার বেঘুম নয়ন জানি,
করবে আমায় নিগাহ-বানী
জানি রাংবে ধুসর দিনগুলি মোর
তোমার আখির ইয়ালা
নবী কামলি ওয়ালা..