বিনয় অর্থ নম্রতা; ভদ্রতাপূর্ণ ও অহঙ্কার বিবর্জিত আচরণের সর্বোচ্চ বহি:প্রকাশ। মানুষের প্রকাশযোগ্য আচরণের মধ্যে বিনয়ী ভাব আল্লাহ তা’আলার কাছে খুবই পছন্দনীয়। এজন্য সকল ঈমানদার, আবেদ, মুত্তাকী, আউলিয়া বা বুজুর্গ ব্যক্তিকে বিনয়ী হতে দেখা যায়। আর চরিত্রের মধ্যে বিনয় বা নমনীয় ভাব না থাকলে কোন ব্যক্তি বুজুর্গীয়ত দাবী করতে পারেন না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন: “দুনিয়াতে অহঙ্কারের সহিত পদক্ষেপ করিও না,” (সূরা: লোকমান, আয়াত- ১৮)। নবী করীম (স:) বলেন: “ক্ষমা করলে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাকারী বান্দার সম্মান ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেন, আল্লাহর জন্য বিনয় ও নম্র ভদ্র আচরণ করলে আল্লাহ পাক তাকে উন্নত করেন এবং উচ্চ পদমর্যাদা দান করেন”।
শেখ সাদী (র:) বলেন: “মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, হে বান্দা! তুমি মাটির ন্যায় নম্র থাক। বিদ্রোহী ও লালসাকারী হয়ো না। আল্লাহ তোমাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তুমি আগুনের মত রাগান্বিত হয়ো না”।
আগুন যখনই অহঙ্কারের সাথে ভায়বহ আকার ধারণ করে অতি উপরে উঠেছে, তখনই মাটি বিনম্র সহকারে নিজের মস্তক নত করে দিয়েছে। আগুন অহঙ্কার দেখাচ্ছে আর মাটি নম্রতা দেখাচ্ছে। তাই আল্লাহ তা’আলা আগুন দিয়ে পাপিষ্ট শয়তান তৈরি করেছেন এবং মাটি দিয়ে সৃষ্টির সেরা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মেঘ হতে এক ফোটা বৃষ্টি সমুদ্রে পতিত হয়ে সমুদ্রের প্রশপ্ততা দেখে লজ্জিত হয়ে পড়ে এবং বলে যে, সমুদ্রের নিকট আমি কিছুই না? সমুদ্র যদি এই হয়, তবে নিশ্চয় আমি শূণ্য।
বৃষ্টির ফোটা যখন নিজেকে ছোট মনে করল তখন ঝিনুক তাকে আদর করে নিজের কোলে নিয়ে প্রতিপালন করল। আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি খুশী হয়ে তাকে রাজা বাদাশাহর অতি মূল্যবান ও প্রিয় বস্তুতে পরিণত করে দিলেন। অধিক সম্মান ঐ ব্যক্তি লাভ করতে পেরেছে, যে প্রথমে নিজেকে ছোট করে দেখেছে। তাই শেখ সাদী (র:) বলেন: “যদি তুমি অধিক সম্মান চাও তবে নম্র হও। কেননা নম্র হওয়া ছাড়া উচ্চ হওয়ার আর কোন পথ নেই। নম্রতাই বড় হওয়ার চাবি”।
নবী করীম (স:) বলেন: ইজ্জত, সম্মান, তাকওয়া- পরহেজগারীর মধ্যে আর আভিজাত্য- কৌলিন্য নিহিত রয়েছে বিনয়-নম্রতার মাঝে এবং অমুখাপেক্ষিতা নিহিত রয়েছে একীন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে”।
আরেক হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যখন আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দেন, অত:পর ইসলামই হয় তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, আর সে এমন কোন কাজে জীবন কাটায় যার মধ্যে অবৈধ কিছু নেই; এরই মাধ্যমে সে জীবিকা অর্জন করে, তার মধ্যে যদি বিনয় তথা নম্র স্বভাব থাকে, তবে সে আল্লাহ তা’আলার নির্বাচিত বিশেষ বান্দা।
বড় পীর গাউসুল আজম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (ক:) তাঁর “গুনিয়াতুত্ ত্বালিবীন” গ্রন্থে মানুষের ১৯ টি নিন্দনীয় অভ্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন। যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এর মধ্যে দ্বাদশ অভ্যাসটি হলো, আচার-আচারণ ও চাল-চলনে গর্ব অহঙ্কার ভাব প্রকাশ করা অর্থাৎ চরিত্রের মধ্যে বিনয়ের অভাব থাকা।
বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, কোন এক সময় হযরত নবী করীম (স:) প্রসারিতভাবে বসেছিলেন, এমনি সময় হযরত জিব্রাইল (আ:) হাযির হয়ে বললেন, হে আল্লাহ পাকের দোস্ত! আপনি এভাবে উপবেশন করুন যেভাবে চাকর তার প্রভুর সামনে বসে।
হযরত হারেস মুহাসেবী (র:) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, একনাগারে চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি কোন কিছুর সঙ্গে হেলান দিয়ে বসেননি। তিনি যখনই বসতেন তখনই দ’হাঁটু সিজদার ন্যায় বিছায়ে বসতেন। মানুষেরা বলতো, আপনি এত কষ্ট করে বসেন কেন? কোন বস্তুর সঙ্গে হেলান দিয়ে তো বসতে পারেন। তিনি জবাবে বলতেন, আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে দ’হাঁটু বিছায়ে বসা ছাড়া অন্যরূপে বসা একজন বান্দার পক্ষে অতি অন্যায় ও লজ্জাজনক ব্যাপার।
খোরাসান দেশে জনৈক বুজুর্গ ছিলেন, মানুষের মাঝে বুলন্দ নামে তিনি মশহুর ছিলেন। তিনি কুড়ি বছর যাবৎ দাঁড়ায়ে ছিলেন। শুধু নামায আদায়ের সময় ছাড়া অন্য কোন সময়ই বসতেন না। মানুষেরা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বলতেন, আমি এখনো মহান প্রভু আল্লাহর দরবারে বসার যোগ্যতা লাভ করিনি। অর্থাৎ আমার কথা হচ্ছে, আমি তাঁর দাস। সুতরাং মনিব দাসকে বসাবস্থায় দর্শন করবে দাসের বেলায় এ অপেক্ষা বড় অন্যায় আর কী হতে পারে? আসলে এটিই হচ্ছে বিনয়ের বহি:প্রকাশ।
রাসূলল্লাহ (স:) বলেছেন, চারটি সৎ স্বভাব আল্লাহ পাক তাকেই দান করেন, যাকে তিনি ভালবাসেন- ১. চুপ থাকার অভ্যাস ২. আল্লাহর উপর নির্ভর করা, ৩. বিনয় অবলম্বন করা ও ৪. দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হওয়া।
মাওলানা রুমী (র:) বলেন- জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তি-তর্ক ও চালাক-চাতুরী, তেজস্বী প্রতিভা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার উপায় নয়। নিবেদিত আত্মা ছাড়া কেউ মহান আল্লাহর দয়া মেহেরবানী লাভ করতে পারে না।
দার্শনিক রুমী (র:) অন্যত্র বলেন, বাগ-বাগিচার সুসজ্জিত বৃক্ষগুলো যেন মানুষকে ডেকে ডেকে বলছে, বীজ যে ভাবে নিজেকে মাটির নীচে ফেলে রাখে, তোমরাও সেভাবে নিজেকে আত্মবিলীনতার মাটির নীচে ফেলে রাখ, তা হলে অনেক উন্নত জীবন লাভে ধন্য হতে পারবে। যদি কিছু উন্নতি চাও তবে নিজের আমিত্ব সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন করে দাও, কেননা বীজ মাটিতে মিশে গিয়ে ফুল এবং ফুল বাগানে রূআন্তরিত হয়। ঋতুরাজ বসন্তেও পাথরের উপর সবুজ শ্যামল বাগান জম্মে না (তেমনি তুমিও যদি অহঙ্কার ও গর্ব-গরিমার পাথর হয়ে থাক তবে তোমার মধ্যে জ্ঞান এবং অধ্যাত্মের ফুল ফুটবে না)। মাটি হয়ে থাক; তবেই রং বেরংয়ের ফুল তোমার মধ্যে ফুটবে।
আল্লামা রুমী (র:) আরেকটি উপমায় বলেছেন, বৃক্ষগুলো পাঁতিহাসের ন্যায় মাথা পানির মধ্যে ডুবিয়ে দেয় (পাঁতিহাস যে রূপ পানির ভিতর মাথা ডুুবিয়ে খাদ্য আহরণ করে, তদ্রƒপ বৃক্ষগুলো নিজ মূল ভূগভৃস্থ পানি জাতীয় রসে ডুবিয়ে রেখে তা থেকে রস সংগ্রহ করে) এবং ময়ূরের মত সুন্দর হয়ে যায়; অথচ ওই বৃক্ষই ইতিপূর্বে (শীতকালে) বিশ্রী বিবর্ণ কাকের ন্যায় ছিল।
অর্থাৎ, সাধারণ মাটির মধ্যে এ গুণ ও ক্রিয়া আছে, তা হেমন্তের প্রকোপে দগ্ধ বৃক্ষের একটি কাল বীজকে ফুলে ফলে সু-সজ্জিত বৃক্ষে রূপান্তরিত করে দেয়। তদ্রƒপ আমিত্ব নিশ্চিহ্ন করে মাটি হয়ে যাওয়া এবং আত্মবিলীনতার মধ্যেও এ গুণ রয়েছে। যে মানুষ কাকের ন্যায় দুনিয়ার মুর্দা লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, সেও যদি নিবেদিত প্রাণ (বিনয়ী) হয়ে আত্মবিলীনতার মাধ্যমে মাটির নীচে এসে যায়, আমিত্ব বিবর্জিত হয়ে নিজেকে হেয় তুচ্ছ পরিগণিত করে, তবে অধ্যাত্মের বসন্তে সে ফুল ফলে সু-সজ্জিত ও সবুজ শ্যামল হয়ে উঠতে পারবে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা করি, যেন তিনি আমাদের সকলকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আচার-আচারণ, চাল-চলন ও কাজ-কর্মে বিনয়ী হওয়ার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।
কলাম লেখকঃ ড. কাজী মোহাম্মদ মেজবাউল আলম
সহযোগী অধ্যাপক
উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।