কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

শরীয়তের মানদন্ডে শবে বরাত ও ফজিলত

শবে বরাত

শবে বরাত মহাগুরুত্বপূর্ণ রজনী। আরবী ও ফারসি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিভাষা যা দিয়ে এশিয়া মহাদেশে শাবানের পনের তারিখের রাতকে বুঝানো হয়। যাকে আরবী ভাষাবাসীরা “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান” বলে থাকে। “শবে বারাত” এই পরিভাষাটি পবিত্র হাদীছের আলোকেই নির্ধারণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। হাদীছ শরিফে বর্ণিত হয়েছে: “এই রাতে আল্লাহ্ তায়ালার রহমতে মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পায়” [ইমাম বাইহাকি, শোয়াবুল ইমান. হাদীছটি বর্ণনা করেছেন হযরত আয়েশা (রাঃ)]

এ ধরনের আরো অনেক ফারসি শব্দ আমরা নিত্যদিন ব্যবহার করি। যেমন: নামাজ, রোজা, খোদা ইত্যাদি। এগুলো কোরান-হাদীছে পাওয়া যাওয়ার কথা না। কারণ শব্দ গুলো ফার্সী। এই ধরনের প্রায় ৬০০০ শব্দ বাংলাতে আমরা ব্যবহার করি।

শবে বারাতের ব্যাপারে পবিত্র কোরানে পাকের ‘সুরা দোখ্খানে’ আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন: “হা মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। নিশ্চয়ই আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করা হয়” (আয়াত ১-৪)
এ আয়াতে বর্ণিত “লাইলাতুম মুবারাকাহ্”র ব্যখ্যায় তাবেয়ীনদের মধ্যে তাফসীরের অন্যতম ইমাম হযরত ইকরামা (রাঃ) সহ অনেক মুফাস্সিরগণ শবে বারাতকে বুঝানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
তবে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) সহ অনেকে বলেছেন এখানে শবে কদর উদ্দেশ্য।
আয়াতের এই শব্দ দিয়ে বহুসংখ্যক তাফসিরের ইমামদের রায় সত্তেও শবে বারাত নিরংকুশভাবে প্রমাণিত না হলেও হাদীছ শরীফে অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত অনেক হাদীছ রয়েছে যা শবে বারাতকে সন্দেহাতীত পন্থায় প্রমান করে। যেমন-

“হুজুর (দঃ) এরশাদ করেন: শবে বরাতের রাতে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং মুশরিক ও অন্যের প্রতি হিংসা পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।” এই হাদীছটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা সুত্রে আটজন জলিলুল কদর সাহাবি বর্ণনা করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন: – হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ), হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), হযরত আবু মুছা আশয়ারী (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আউফ বিন মালিক (রাঃ), হযরত আবু ছা’লাবা (রাঃ)

উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীছ বিশারদ ইমামুল মুহাদ্দিছীন শাইখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দেছে দেহলভী উনার বিখ্যাত কিতাব ‘মা ছাবাতা বিছ্ছুন্নাহ্ ফি আইয়্যামিছ ছানাহ্’ -তে একটা অধ্যায় করেছেন শবে বরাতের উপর এবং এই রাতের ফজিলত ও ইবাদত বন্দেগি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হদীছ উল্লেখ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

মুহাদ্দেসীন এই হাদীছকে সহিহ্ বলেছেন। এমনকি বর্তমান যুগের সালাফীদের মুরব্বি শায়খ আলবানিও এই হাদীছকে নিঃসন্দেহে সহিহ্ বলেছেন (দেখুন: শায়খ আলাবানি কৃত “সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা” খন্ড:৩, পৃ:১৩৫, হাদীছ নং:১১১৪)

আরো পড়ুন:

“হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসুল (দঃ) বলেছেন: যখন শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত আসবে তখন তোমরা ঐ রাত জেগে ইবাদত কর এবং এর পরদিন রোজা রাখ। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা ঐদিন সুর্যাস্তের পর (নীজ শান অনুযায়ী) দুনিয়ার আসমানে আবিভূত হয়ে আহবান করেন: তোমাদের মধ্যে কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি মাফ করে দেব। রিজিকের প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি রিজিক দিব। কোন বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি বিপদ থেকে মুক্তি দিব। এভাবে ফজর পর্য্যন্ত আরো বান্দাদের সম্বোধন করতে থাকেন।” -(ইবনে মাজা, শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত অধ্যায়, হাদীছ নং:১৩৮৮)

গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানি (র:) উনার বিখ্যাত কিতাব “গুনিয়াতুত তালেবীন”-এ শবে বরাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন।

মিশরের প্রখ্যাত আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি আইনবিধ মুফতি আতিয়া ছকরকে এই রাতের ফজিলতের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উনি ফতোয়া দেন:
“এই রাতের ফজিলতের উপর যেই সমস্ত হাদীছ শরিফ বর্ণিত হয়েছে তা কোন কোন মুহাদ্দিসগণ সহিহ্ বলেছেন আবার কেউ কেউ ‘দায়ীফ’ বলেছেন। তবে কথা হচ্ছে ‘দায়ীফ’ হলেও তা ফাজায়েলে আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।” (আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া নং ১৩১১১০)

ইবনে তাইমিয়া বলেছেন: “শাবানের চৌদ্দ তারিখের রাতের ফজিলত সম্পর্কিত অনেক হাদীছ ও আছার রয়েছে। ছলফে ছালেহীনের কেউ কেউ এই রাতে রাত জেগে নফল নামাজ আদায় করতেন।” -(আল ফাতওয়া আল-কুবরা, নং ৫৩৪৪)

ইবনে তাইমিয়া তার “ইকতিদাউ ছিরাতিল মুছতাকিম” কিতাবে শবে বরাত সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন: “শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীছে মারফু ও আছার (সাহাবা ও তাবেঈনের অভিমত) বর্ণিত হয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে, এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত। সলফে সালেহীনের কেউ কেউ এই রাতে এবাদত বন্দেগি করতেন। পবিত্র মদিনা নগর সহ অনেক জায়গার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ওলামা এটাকে অস্বীকার করেছেন এবং এই সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীছের সমালোচনা করেছেন। যেমন: হাদীছ শরিফে এসেছে: এই রাতে আল্লাহ্ বনি কালব গোত্রের মেষপালের পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।
তবে আমাদের অধিকাংশ আহলে ইলম্ ওলামায়ে কেরামের মতে এই রাত ফজিলতপূর্ণ। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) এর বর্ণিত হাদীছ এর উৎকৃস্ট প্রমাণ। তাছাড়া এই বিষয়ে আরো অসংখ্য হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সাথে রয়েছে সলফে সালেহীন ও আকাবিরীনে উম্মতের রায়।” -( ইকতিদাউ ছিরাতিল মুছতাকিম” পৃস্টা: ২৭৩)

এই বরকতপূর্ণ রাতেও কতিপয় লোক আল্লাহ্ তায়ালার দয়া-অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে বলে বিভিন্ন হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

  • যারা শির্ক করে
  • যাদের অন্তর হিংসা আর ক্রোধের আগুনে ভর্তি
  • অহংকারী
  • মানুষ হত্যাকারী
  • আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী
  • পিতামাতার অবাধ্য সন্তান
  • মদ্যপানে নেশাগ্রস্ত
  • গিবত বা পরচর্চাকারী অর্থাত্ যারা সারাদিন বসে বসে অন্য মানুষের দোষত্রুটি বর্ণনা করে।

তবে কেউ যদি এই রাতে তাওবা করেন তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই তাওবা কবুল করেন এবং ক্ষমা করেন।

এই রাতের মৌলিকত্ব হচ্ছে- তাওবা-ইসতিগফার এবং ইবাদত-রিয়াঝতের মাধ্যমে মহান প্রভুকে সন্তুষ্ট করা। কাজেই আমাদের উচিত হবে বন্ধুদের নিয়ে হাসি-তামাশা, আড্ডাবাজি, আতশবাজি বা ঘুরাঘুরি না করে রাতটির প্রতি যতাযত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক নিম্নলিখিত আমলগুলো করার চেষ্টা করা:

  • নিকট আত্মিয়, পাড়া প্রতিবেশির কবর জিয়ারত করা
  • বেশি বেশি তাওবা-ইসতিগফার করা
  • কোরান তিলাওয়াত করা।
  • সুরা ইয়াছিন, রহমান, মুলক্ পাঠ করা
  • দোয়া ইউনুছ পাঠ করা
  • বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা
  • জিকির করা
  • তাওবার নামাজ, সালাতুত তাসবীহ্
  • তাহাজ্জুদ এবং ইবাদত বান্দেগীর মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করা।

পোস্টটা শায়খ সাইফুল আজম আল আজহারি সাহেবের ফেসবুক থেকে সংক্ষেপিত।