কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

ধীরে ধীরে দেশের শিল্পখাতে জায়গা করে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)

বর্তমান সময় একটি কথা আমরা প্রায় শুনছি। তাহলো; ভবিষ্যতে শ্রমিকদের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা রোবট। শুধু যে শ্রমিক তা কিন্তু নয়, অনেক জায়গায় কর্মকর্তাদেরও বিকল্প হয়ে উঠবে। তবে এখানে মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশংকা যেমন আছে ঠিক তেমনি নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা। প্রথমে আসা যাক পোশাক শিল্পের কথায়। রপ্তানি খাতের মধ্যে পোশাকই হলো আমাদের দেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত।

পোশাকখাতে দিন দিন প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসছে, সামনের দিনগুলোতে আরো আসবে। তাই বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র চালাতে সক্ষম কর্মীর চাহিদাও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পোশাকশিল্পে আধুনিক এসব যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক শ্রমিক পিছিয়ে আছেন। এই খাতে যেহেতু নারীকর্মীর সংখ্যাই বেশি তাই নারীদের চাকরি হারাতে হচ্ছে বেশি। আবার অনেক সময় দেখা যায় নারীরা পুরুষদের মতো প্রশিক্ষণের সুযোগ পান না। পোশাকখাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পোশাক কারখানায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে যার কারণে যন্ত্রপাতি ব্যবহারে দক্ষ শ্রমিকদের প্রাধান্যও দেয়া হচ্ছে বেশি । তাই শিল্প কারখানার মালিকদের প্রয়োজন শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য খুব দ্রুত প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

আরো পড়ুন:

দিনমজুরের কাজ বলেন কিংবা পোশাক শ্রমিকের কাজ কিংবা বড় শিল্পকারখানা এই জায়গাগুলোয় যত বেশি অটোমেশন হবে, ততই শ্রমিকের সংখ্যা কমে আসবে। অটোমেশন হলো মানুষ আর রোবটের সমন্বয়ে কাজ। অর্থাৎ পুরো কাজটাই রোবট করবে না, বরং সেখানে মানুষের সহায়তাও লাগবে যাকে বলা হয় ‘কোবট’ বা কলাবরেটিভ রোবট। রোবটগুলো মানুষের সাথে একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করবে। যাকে বলা যায় ‘হেল্পিংহ্যান্ড’। এতে কম পরিশ্রমে কম সময়ে যেকোনো কাজ করা সম্ভব হবে।

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মনে করেন, বর্তমানে এ খাতে একটা বড় সমস্যা হলো দক্ষ লোকের অভাব।বর্তমান বাজার চাহিদায় যে ধরনের দক্ষ লোক দরকার সেই ধরনের দক্ষ লোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে পারছে না। রোবট কিংবা আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোকে অপারেট করতে লাগবে দক্ষ মানুষ। তাহলে বুঝা যাচ্ছে শীঘ্রই দক্ষতাই হবে যোগ্যতার মাপকাঠি।

এবার আসা যাক আমাদের দেশের একটি প্রযুক্তি নির্ভর কারখানার কথায়। বলছি ওয়ালটনের কথা। যেটি বাংলাদেশের বৃহত্তম টেক কোম্পানিগুলোর অন্যতম। এর মূল কারখানা গাজীপুর জেলায় অবস্থিত।

ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মোবাইল, এয়ার কন্ডিশনার, নানা রকম হোম অ্যাপ্লায়েন্স অর্থাৎ গৃহস্থালি প্রযুক্তিপণ্য এবং ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারক এই কোম্পানি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৭ সালে, ইস্পাত শিল্পের মাধ্যমে। প্রায় ৪৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রা। আজও ওয়ালটন ছুটছে পূর্ণোদ্যমে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশীয় পণ্য। পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে তুলতে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে প্রযুক্তির।

বর্তমানে ৭৫০ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত বিশাল এই কারখানার অনেকাংশই স্বয়ংক্রিয়। এক কথায় বলা যায়, পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন ধাপে রোবটিক্সের প্রয়োগ। বিভিন্ন ধাপে ওয়ালটন স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে কাজগুলো করে থাকে। এখনো পর্যন্ত যে কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় নয় (যে কাজগুলো কর্মীদের মাধ্যমে হয়) সেগুলোও ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলার চেষ্টা করছে ওয়ালটন।

প্রাত্যহিক জীবন সহজ করার জন্য ওয়ালটনও এগোচ্ছে আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের পথেই। কারণ এটি ছাড়া বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব বাজারে টিকে থাকা হবে কঠিন। অতীতে অনেক স্বনামধন্য কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে শুধুমাত্র যুগের সাথে নিজেদের বদলাতে পারেনি বলে।

এদিকে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো করে ওয়ালটন তৈরি করেছে একটি সম্পূর্ণ দেশি ধাঁচের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ‘ওকে গুগল বললে যেমন সাড়া দেয় গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, তেমনি ‘হ্যালো ওয়ালটন’ বলে ডাকলেই জবাব দেবে ওয়ালটনের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর মাধ্যমে ওয়ালটন গড়ে তুলছে তাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেম বা স্মার্টহোম। ‘ওয়ালটন স্মার্টহোম অ্যাপ্লায়েন্সস’ নামে একটি অ্যাপও আছে প্লেস্টোরে, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাদের ফ্রিজ, এসিসহ অন্য গৃহস্থালি প্রযুক্তিপণ্য। তবে পূর্ণাঙ্গ স্মার্টহোম হয়ে উঠতে আরও কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে ওয়ালটনকে।

তারপরও বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট এ দেশের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়ালটন এত অল্প সময়ে যতগুলো কাজ করেছে তা প্রশংসার দাবিদার।

ওয়ালটন মূলত দুটো দর্শন নিয়ে এগোচ্ছে। এক. অন্যান্য ব্যবসায়িক খাতে বিনিয়োগ না করে সম্পর্ণ মনোযোগ প্রযুক্তি খাতে দেওয়া এবং এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দুই. এ ক্ষেত্রে বিদেশি মেধাকে কাজে লাগানোর চেয়ে দেশি মেধাকে বেশি কাজে লাগানো।

ওয়ালটনের আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো ইলেকট্রিক কার বা বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির চিন্তা। টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির মতো অনেকই এখন যেমনঃ অ্যাপল, গুগল এমনকি শাওমির মতো চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোও ঝুঁকছে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের দিকে। সেখানে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের এমন প্রচেষ্টা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সবটাই ওয়ালটন করছে গ্রিন বা সবুজ প্রযুক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। তাই এই বিশাল কারখানায় দেখা যাবে না খুব বেশি ময়লা বা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বরং বারতি যে জিনিসপত্র অবশিষ্ট থাকবে তা গলিয়ে আবার কাজে লাগানো হবে।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে দেশি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রচেষ্টা। মূলত প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে দেশি মেধার ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয়তা এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠছে এবং সামনে এগোচ্ছে আমাদের দেশিও এই প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন।

তাহলে এবার ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, বর্তমান নতুন প্রজন্মকে কিভাবে দক্ষতাসম্পন্ন করে তোলা প্রয়োজন । সামনে চাকরির বাজারে অনার্স-মাস্টার্সের সনদের চেয়ে দেখবে দক্ষতাসম্পন্ন লোক। শুধুমাত্র সনদ আর জিপিএ-৫ দেখে চাকরি পাওয়ার সময় শেষ। এগুলো চাকরির বাজারে কাজ দিবে খুব কম। একটা সময় ছিল এগুলোর কদর ছিল খুব।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এখন চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। রোবটিক্সের হাত ধরেই নতুন শিল্পবিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলছে বিশ্ব। কারখানার কর্মী, নাবিক, সৈনিক, ওয়েটার, ডাক্তার এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজেও মানুষকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে রোবট।

তাই এখননিই প্রয়োজন জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা। সর্বোপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন প্রজন্মের জন্য যুগোপযোগী করে তোলা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজা প্রয়োজন। শিল্প-কারখানায় কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে, সে বিষয়টিও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার।

তবে সবার আগে ভালো মানুষ হওয়াটা খুব জরুরি। সবকিছু ভেস্তে যাবে, যদি মানুষ হিসেবে ভালো না হই। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে সেভাবেই।