কোরআন পড়ুন

খুঁজুন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: একটি বিশ্লেষণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত একটি ইভেন্ট। এটি শুধুমাত্র আমেরিকার জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতি চার বছর পর অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জনগণ তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন।

নির্বাচন প্রক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল এবং এর রয়েছে কয়েকটি স্তর। এই প্রক্রিয়াটি মূলত প্রাইমারি এবং ককাস দিয়ে শুরু হয়, যেখানে বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী বাছাই করে। এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি। ইলেকটোরাল কলেজে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট থাকে এবং একটি প্রার্থীর প্রেসিডেন্ট হতে গেলে তাকে ২৭০টি ভোট অর্জন করতে হয়।

ইলেকটোরাল কলেজ কী?

ইলেকটোরাল কলেজ হলো এমন একটি সংস্থা যা আমেরিকার জনগণের ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে। ইলেকটোরাল কলেজের মোট ৫৩৮টি ভোট থাকে, যেখানে প্রতিটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ওই রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। প্রেসিডেন্ট হতে একজন প্রার্থীকে মোট ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট জিততে হয়, যা মোট ভোটের অর্ধেকের বেশি।

ইলেকটোরাল ভোট বন্টনের নিয়ম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট সংখ্যা রাজ্যগুলোর জনসংখ্যা অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাধারণত রাজ্যের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সেনেটের সদস্য সংখ্যা যোগ করে একটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে (৫৫টি), কারণ এটি সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। অন্যদিকে, অ্যালাস্কার মতো ছোট রাজ্যগুলিতে কেবল তিনটি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।

ইলেকটোরাল ভোটের কাজ করার পদ্ধতি

প্রতিটি রাজ্যে সাধারণত “winner-takes-all” নিয়ম অনুযায়ী ইলেকটোরাল ভোট প্রদান করা হয়, অর্থাৎ যে প্রার্থী এক রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি সেই রাজ্যের সমস্ত ইলেকটোরাল ভোট জিতে নেন। তবে মেইন এবং নেব্রাস্কা রাজ্য দুইটি একটু ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে ইলেকটোরাল ভোটগুলো কিছুটা অনুপাতে বিভক্ত হতে পারে।

ইলেকটোরাল ভোটের সুবিধা এবং সমালোচনা

ইলেকটোরাল ভোট পদ্ধতির কিছু সুবিধা ও সমালোচনা রয়েছে:

সুবিধা:

  • এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেয়।
  • সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের মতে, এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি, যা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চেয়ে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে।

সমালোচনা:

  • জনমতের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে এটি প্রতিনিধিদের ওপর নির্ভর করে।
  • এতে জনপ্রিয় ভোটে বিজয়ী প্রার্থীও ইলেকটোরাল ভোটে পরাজিত হতে পারেন, যেমনটি ২০১৬ সালের নির্বাচনে ঘটেছিল।

২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনপ্রিয় ভোট এবং ইলেকটোরাল ভোটের ফলাফলের মধ্যে এক অস্বাভাবিক ব্যবধান দেখা গিয়েছিল। এতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকটোরাল ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন জনপ্রিয় ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এই ঘটনা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির একটি বড় সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানে ২০১৬ সালের এই নির্বাচনের বিশদ বিবরণ এবং কেন জনপ্রিয় ভোটে জয়ী হয়েও কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না তা ব্যাখ্যা করা হলো:

২০১৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে:

  • হিলারি ক্লিনটন জনপ্রিয় ভোটে ৬৫.৮ মিলিয়ন ভোট পান, যা মোট ভোটের প্রায় ৪৮.২% ছিল।
  • ডোনাল্ড ট্রাম্প জনপ্রিয় ভোটে ৬২.৯ মিলিয়ন ভোট পান, যা মোট ভোটের প্রায় ৪৬.১% ছিল।

অর্থাৎ, জনপ্রিয় ভোটে ক্লিনটন প্রায় ২.৯ মিলিয়ন ভোটে এগিয়ে ছিলেন। তবে ইলেকটোরাল কলেজে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ইলেকটোরাল ভোটে ট্রাম্প ৩০৪টি ভোট এবং ক্লিনটন ২২৭টি ভোট পান। ফলে ইলেকটোরাল ভোটে ট্রাম্প বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হন।

ইলেকটোরাল কলেজের প্রভাব এবং ‘Winner-Takes-All’ পদ্ধতি

ইলেকটোরাল কলেজের বিশেষ পদ্ধতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এমন হয় যে একজন প্রার্থী যদি এককভাবে অনেক রাজ্য জিততে পারেন, তাহলে তিনি তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয় ভোট পেলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। বেশিরভাগ রাজ্যে “winner-takes-all” পদ্ধতি প্রচলিত, যেখানে যে প্রার্থী এক রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি সেই রাজ্যের সমস্ত ইলেকটোরাল ভোট পান। এই পদ্ধতির কারণে কিছু রাজ্যে অল্প ব্যবধানেও বেশি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

জনপ্রিয় ভোটে জিতেও প্রেসিডেন্ট হতে না পারার কারণ

জনপ্রিয় ভোটে বেশি ভোট পাওয়া মানেই ইলেকটোরাল ভোটে বেশি পাওয়া নয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে, হিলারি ক্লিনটন বড় শহর এবং জনবহুল রাজ্যগুলোর যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক ইত্যাদিতে বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এসব রাজ্যের জনসংখ্যা বেশি হলেও ইলেকটোরাল কলেজে সীমিত প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন ছোট রাজ্যগুলোতে অল্প ব্যবধানে হলেও বিজয়ী হওয়ায় তাদের ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যান। ফলে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে তিনি এগিয়ে যান এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির সমালোচনা

ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি নিয়ে ২০১৬ সালের পর আরও বেশি সমালোচনা শুরু হয়, কারণ এটি সরাসরি জনমতের প্রতিফলন দেয় না। অনেকেই মনে করেন যে এই পদ্ধতিটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এবং এটিকে বাতিল করে সরাসরি জনপ্রিয় ভোটের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত। তবে এর বিপরীতে অনেকেই মনে করেন, ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি ছোট রাজ্যগুলির মতামতকে সুরক্ষা দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামোকে মজবুত রাখে।

অতীতে আরও এমন ঘটনা

২০১৬ সালের আগে আরও কয়েকবার এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে জনপ্রিয় ভোটে এগিয়ে থেকেও প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ:

  • ২০০০ সালে, আল গোর জনপ্রিয় ভোটে জয়ী হন, কিন্তু ইলেকটোরাল ভোটে জর্জ ডব্লিউ. বুশ প্রেসিডেন্ট হন।
  • ১৮৮৮ সালে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড জনপ্রিয় ভোটে জয়ী হলেও ইলেকটোরাল ভোটে বেনজামিন হ্যারিসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকটোরাল ভোট পদ্ধতি একটি প্রাচীন ও ব্যতিক্রমী নির্বাচন পদ্ধতি, যা বিভিন্ন কারণে আলোচিত ও সমালোচিত। এটি বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি, কখনও কখনও জনমতের পরিপূর্ণ প্রতিফলনও হয় না। তবে এই পদ্ধতিটি এখনও মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থায় অপরিহার্য ও প্রচলিত।